শিলিগুড়িতে অভিশাপের ছায়া ও মানসিক অবক্ষয়
শিলিগুড়ি ফিরে আসার পর প্রথম কয়েকটা দিন অর্কের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো কাটল, যেন সে এক অনন্ত মানসিক কারাগারের বাসিন্দা। উইন্ডসর হাউসের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যেন তার মনের গভীরে এক কালো গহ্বর তৈরি করেছিল, যা তাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করছিল, তার আত্মাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সে ছিল এক নীরব সাক্ষী, এক ভয়াবহ বাস্তবতার শিকার, যা তাকে ভিতর থেকে ভেঙে দিয়েছিল, তার মানসিক কাঠামোকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। ঘুমোতে গেলেই উইন্ডসর হাউসের সেই অন্ধকার হলঘর, পিয়ানোর করুণ সুর আর এলিজাবেথের অস্পষ্ট ছায়া মূর্তি তার চোখে ভেসে উঠত, প্রতিটি চিত্র যেন তার মস্তিষ্কের দেওয়ালে জ্বলন্ত কালিতে আঁকা, যা তাকে ঘুমোতে দিচ্ছিল না, তার প্রতিটি স্বপ্নকে নরকে পরিণত করছিল, তাকে উন্মাদ করে তোলার চেষ্টা করছিল।
তার ঘুমের রুটিন পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছিল। মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যেত ভয়ে, তার বুক ধড়ফড় করত, যেন এক্ষুনি তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর সে বাকি রাতটা জেগে থাকত, সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে, তার চারপাশে যেন অদৃশ্য চোখ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে, প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করছে, তার প্রতিটি দুর্বল মুহূর্তের অপেক্ষায়। তার ঘরের কোণায় অস্পষ্ট ছায়া নড়াচড়া করতে দেখত, মনে হতো যেন সেই ছায়াগুলোই উইন্ডসর হাউস থেকে তার পিছু নিয়েছে, তাদের নীরব উপস্থিতি তাকে জানান দিত যে সে একা নয়, তার চারপাশে সবসময় অদৃশ্য সত্তা রয়েছে, তাকে পর্যবেক্ষণ করছে, তার প্রতিটি দুর্বল মুহূর্তের অপেক্ষায়, তাকে গ্রাস করার জন্য, তার আত্মাকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য, তাকে চিরতরে বন্দি করার জন্য, তাকে চিরন্তন নরকে ঠেলে দেওয়ার জন্য, তাকে চিরতরে নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য। দিনের বেলায়ও তার বিভ্রম শুরু হলো। পরিচিত মুখগুলো যেন বিকৃত হয়ে যেত, তাদের চোখ থেকে এক অস্বাভাবিক আলো নির্গত হত। সে যখন আয়নার সামনে দাঁড়াতো, তখন নিজের প্রতিচ্ছবিতে এক অস্পষ্ট ছায়া দেখত, যা তাকে উপহাস করে হাসত, মনে হতো যেন সেই ছায়াটাই ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করছে, তার নিজের সত্তাকে মুছে দিচ্ছে। সে নিজেকে চিনতে পারছিল না, তার মনে হচ্ছিল সে ধীরে ধীরে অন্য কেউ হয়ে যাচ্ছে, এক প্রাণহীন পুতুল, যার চালিকাশক্তি অন্য কোনো অদৃশ্য সত্তা।
অফিসের কাজে মনোযোগ দিতে পারছিল না, তার হাতের লেখা কাঁপছিল, মন বিক্ষিপ্ত ছিল, প্রতিটি ফাইল, প্রতিটি কাগজ তার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছিল। সহকর্মীদের সাথে তার স্বাভাবিক ব্যবহার বদলে গিয়েছিল, সে নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল, তার চারপাশে যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি হয়েছিল, যা তাকে বাইরের জগৎ থেকে আলাদা করে দিয়েছিল, তাকে একাকীত্বের গভীরে ঠেলে দিচ্ছিল, এক নির্জন কারাগারে, যেখানে সে কেবল একা, নিঃসঙ্গ, আর তার নিজের আত্মাও তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল, তার অস্তিত্বই যেন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছিল।
সে জানত, এই ভয় তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, তার ভেতরের শান্তি পুরোপুরি কেড়ে নিচ্ছিল, তাকে এক জীবন্ত নরকে পরিণত করেছিল, যেখানে মুক্তি নেই, কেবল অনন্ত যন্ত্রণা, এক অবিরত কষ্ট, এক অকল্পনীয় পীড়ন, যা তাকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তার জীবনকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছিল, তার আত্মার উপর এক গভীর ক্ষত তৈরি করছিল, যা সারানোর কোনো উপায় ছিল না, যা তাকে চিরকাল ভোগাবে। তার চারপাশে যেন সবসময় এক অদৃশ্য ঠান্ডা বাতাস বয়ে যেত, আর তার কানে ভেসে আসত অস্পষ্ট ফিসফিসানি, যা তাকে তার নিজের নাম ধরে ডাকত, তাকে তার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য করত, তার sanity কেড়ে নিতে চাইত, তাকে উন্মাদনার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তাকে নিজের হাতেই ধ্বংস করতে চাইছিল, তাকে এক করুণ পরিণতিতে পৌঁছে দিচ্ছিল, তাকে এক জীবন্ত দুঃস্বপ্নে আটকে রাখছিল। তার চোখের নিচে গভীর কালি পড়ে গিয়েছিল, তার চেহারা ফেঁকাশে হয়ে গিয়েছিল, যেন সে এক মৃতদেহ, যার জীবনশক্তি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, সে যেন এক জীবন্ত প্রেতাত্মা, যা কেবল বেঁচে থাকার অভিনয় করছে, তার ভেতরের আত্মা মরে গেছে, কেবল শরীরটা বেঁচে আছে, একটি ফাঁকা খোলস, যা কেবল শ্বাস নিচ্ছে, এক যন্ত্রণা ভরা অস্তিত্ব, এক নিরন্তর কষ্ট, এক অন্তহীন বিলাপ। বাসে বসেও তার চোখ বুজলেই ভেসে উঠছিল সেই ভিক্টোরিয়ান পোশাক পরিহিত ছায়া মূর্তি, তার অস্পষ্ট, কিন্তু ভীতিকর রূপ, আর কানে বাজছিল পিয়ানোর করুণ সুর, যা তার মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ুকে বিদ্ধ করছিল, তার কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছিল। কালিম্পং-এর সুন্দর স্মৃতিগুলির সঙ্গে উইন্ডসর হাউসের সেই অভিশপ্ত রাতের স্মৃতিটা চিরকাল তার মনে এক গভীর রহস্যের জাল বুনেছিল। সে বুঝতে পারছিল, এই অভিজ্ঞতা তাকে আমূল বদলে দিয়েছে, আর তার জীবন আর কখনো আগের মতো হবে না, সে এক নতুন সত্তায় পরিণত হয়েছে, যা চিরকাল এই ভয়ের সাথে বেঁচে থাকবে, তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে এই ভয় মিশে থাকবে।
চলবে….
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion