Episode 51209 words0 views

অভিশপ্ত পিয়ানো : পঞ্চম অধ্যায়

রহস্যের সূত্রপাত: অনলাইন ফোরাম ও ম্যাকনিলের প্রবন্ধ অর্ক বুঝতে পারছিল যে, কেবল পালিয়ে এসে এই ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ না করলে তার শান্তি ফিরবে না, তার আত্মা মুক্তি পাবে না, তার জীবন চিরকাল এক অস্থির অবস্থায় থাকবে। তার ভেতরের কৌতূহল এবং এই ভয় থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে থামতে দিল না। সে প্রথমে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করল, তার পুরনো ল্যাপটপের ধুলো ঝেড়ে বসল, যেন এক নতুন যুদ্ধে নামার আগে অস্ত্র পরিষ্কার করছিল। তার কম্পিউটারের স্ক্রিনে টাইপ করে চলল: “Windsor House Kalimpong haunted,” “British bungalows Kalimpong history,” “supernatural occurrences Kalimpong,” “Kalimpong ghost stories,” “unexplained events Kalimpong villas,” “paranormal investigations Kalimpong” – এই ধরনের কি-ওয়ার্ড দিয়ে সে সার্চ করতে লাগল, প্রতিটি সার্চে যেন তার অস্তিত্বের এক নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছিল, এক অজানা জগতের দ্বার উন্মোচন হচ্ছিল, যা আগে তার কল্পনারও বাইরে ছিল। প্রথম দিকে তেমন কিছু পেল না। কিছু ভ্রমণ ব্লগ আর পুরনো সম্পত্তি বিক্রির বিজ্ঞাপন ছাড়া বিশেষ কিছু তথ্য ছিল না, যা তার প্রাথমিক হতাশাকে আরও বাড়িয়েছিল, তার মনে হচ্ছিল সে একটি ফাঁকা ঘরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু হাল ছাড়ল না অর্ক। তার অদম্য ইচ্ছা তাকে থামতে দিল না। সে তার সার্চের পরিধি বাড়াল। পুরনো ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস, পাহাড়ি এলাকার সংস্কৃতি, এমনকি কালিম্পং-এর স্থানীয় লোককথা সম্পর্কেও সে ঘাঁটতে শুরু করল, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল, যেন তার সামনে এক বিশাল ধাঁধা, যার প্রতিটি অংশ তাকে সমাধান করতে হবে, তার নিজের অস্তিত্বের জন্য। তার মনে হলো, কোনো এক অশুভ শক্তি তাকে এই রহস্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেন তাকে তার নিজের নিয়তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তার ভাগ্যকে বেঁধে ফেলছে এক অদৃশ্য সুতোয়, যা তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে, তাকে এক অনিবার্য পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, যেখানে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, কেবল অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাওয়া। একদিন গভীর রাতে, যখন চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু কম্পিউটারের স্ক্রিনের নীলচে আলো তার মুখ আলোকিত করছিল, তার চোখে এক অদ্ভুত অস্থিরতা ছিল, সে একটি পুরনো অনলাইন ফোরাম খুঁজে পেল, যেখানে ভারতের ভৌতিক স্থান নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়। তার হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল, যেন এক আসন্ন সত্যের পূর্বাভাস দিচ্ছিল, তার কানের পাশে ধুকপukানি বাজছিল। সেখানে ‘কালিম্পং-এর উইন্ডসর ভিলা’ নামে একটি থ্রেড ছিল, যার শিরোনামই তার রক্ত হিম করে দিল, তার শরীর শিহরিত হলো। অর্ক অবাক হয়ে দেখল, সেখানে আরও অনেকেই উইন্ডসর হাউসের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে। তাদের মধ্যে একজন লিখেছিল যে, সে পিয়ানোর আওয়াজ শুনেছিল, আরেকজন দেখেছিল ছায়া মূর্তি। কেউ কেউ ঘরের মধ্যে তীব্র পচাগন্ধের কথাও উল্লেখ করেছিল, ঠিক যেমনটা অর্ক অনুভব করেছিল। এই সব দেখে অর্কের মনে হলো, সে একা নয়, এই ভিলাতে আরও অনেকেই এমন অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছে, যা তার নিজের অভিজ্ঞতাকে আরও সত্য বলে প্রমাণ করছিল, তার ভয়কে বাড়িয়ে তুলছিল। তবে ফোরামে একটি সতর্কবার্তা ছিল – “উইন্ডসর হাউসের গভীর রহস্যে প্রবেশ করা বিপজ্জনক। যারা প্রবেশ করেছে, তারা অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসেনি, অথবা ফিরে এলেও তারা চিরদিনের জন্য বদলে গেছে, তাদের মন আর স্বাভাবিক থাকেনি, তাদের জীবন নরকে পরিণত হয়েছে, তাদের আত্মা চিরতরে বন্দি, এক অনন্ত যন্ত্রণায়।” এই সতর্কবার্তা তাকে আরও কৌতূহলী করে তুলল, এবং একই সাথে এক হিমশীতল ভয় তার বুকে চেপে বসল, তার হৃদপিণ্ড যেন কেঁপে উঠল, প্রতিটি স্পন্দনে যেন মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল, তার শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল, তার চেতনা লুপ্ত হতে চাইছিল। ফোরামের একটি পোস্ট থেকে অর্ক একটি পুরনো গবেষণা প্রবন্ধের সন্ধান পেল, যা তার অনুসন্ধানের এক নতুন দিক উন্মোচন করল, যেন এক বন্ধ দরজা খুলে গেল। প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিল একজন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ, ড. অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকনিল দ্বারা, যিনি ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের ব্রিটিশ উপনিবেশের স্থাপত্য এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করতেন, তার প্রতিটি শব্দে ছিল গভীর জ্ঞানের ছাপ। প্রবন্ধের একটি অংশে উইন্ডসর হাউসের উল্লেখ ছিল। সেখানে লেখা ছিল যে, এটি জনসন পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল, যারা ১৮৫০-এর দশকে কালিম্পং-এ বসতি স্থাপন করেন। এই অঞ্চলের ব্রিটিশদের মধ্যে জনসন পরিবার বেশ প্রভাবশালী ছিল, তাদের ক্ষমতা ছিল ব্যাপক। ম্যাকনিল প্রবন্ধে একটি বাক্য ব্যবহার করেছিলেন, “উইন্ডসর হাউস – যেখানে সময় নিজেই থেমে গেছে, এবং অতীতের প্রতিধ্বনি চিরন্তন হয়ে উঠেছে, মৃত্যুর শ্বাস সেখানে প্রতি মুহূর্তে অনুভূত হয়, যেখানে প্রতিটি ছায়া এক গল্পের নীরব সাক্ষী, এক অবরুদ্ধ আর্তনাদ, যা চিরকাল সেখানে প্রতিধ্বনিত হবে, যারা শুনবে তাদের আত্মাকে গ্রাস করবে, তাদের মনকে বিকৃত করবে।” এই বাক্যটি যেন ম্যাকনিলের নিজেরই মানসিক যন্ত্রণার প্রতিফলন ছিল, যেন তিনি নিজেই সেই ভয়ের শিকার ছিলেন। ড. ম্যাকনিলের প্রবন্ধটি থেকে অর্ক জনসন পরিবারের সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পেল। মিস্টার জনসন, পুরো নাম হেনরি জনসন, একজন চা ব্যবসায়ী ছিলেন, যার ব্যবসা ছিল বিশাল। তার স্ত্রী এলিজাবেথ জনসন, ছিলেন একজন পিয়ানোবাদক। তার সুরের জাদু অর্ক নিজ কানে শুনেছে, এবং যা তাকে আজও তাড়া করে। এলিজাবেথ ছিলেন একজন গভীর আবেগপ্রবণ, সংবেদনশীল এবং কিছুটা অন্তর্মুখী নারী। প্রকৃতির প্রতি তার ছিল অসীম ভালোবাসা, কিন্তু একই সাথে তিনি এক গভীর বিষণ্ণতা এবং একাকীত্বে ভুগতেন। তার কোনো সন্তান ছিল না, এবং এই অপ্রাপ্তি তার মনে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছিল। এই শূন্যতাই যেন ছিল তার দুর্বলতা, যা তাকে বাইরের জগতের প্রতি, বিশেষ করে কালিম্পং-এর স্থানীয় লোককথা এবং প্রাচীন গল্পগুলির প্রতি, এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করতে বাধ্য করেছিল। ম্যাকনিলের অপ্রকাশিত নোট থেকে অর্ক আরও জানতে পারল যে, এলিজাবেথ প্রায়শই স্থানীয় লেপচা উপজাতির প্রাচীন গান এবং সুর সংগ্রহ করতেন, এবং সেগুলোকে নিজের পিয়ানোতে বাজানোর চেষ্টা করতেন। তার পিয়ানোটি ছিল তার একমাত্র আশ্রয়, তার বন্ধু, যেখানে তিনি তার সব আবেগ ঢেলে দিতেন। ম্যাকনিল উল্লেখ করেছিলেন যে, এলিজাবেথ ভিলার নির্জনতম, অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানগুলিতে, বিশেষত পুরনো লাইব্রেরির কাছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতেন, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির সাথে কথা বলতেন, যা তাকে নিজের প্রতি আকর্ষণ করছিল। এই নিবিড়তার কারণে, যখন তিনি বাতা-ফোলার নিকটবর্তী স্থানে পিয়ানো বাজাতেন, তখন তার সংবেদনশীল আত্মা সেই ‘পৃথিবীর নিচের শক্তি’র কাছে আরও বেশি উন্মুক্ত হয়ে পড়ত, যেন তার সুরই সেই পোর্টালকে জাগিয়ে তুলছিল। এলিজাবেথ জনসন ১৮৮৮ সালে ভিলাতে এক দুর্ঘটনায় মারা যান। কিন্তু ম্যাকনিল তার মৃত্যু সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু লেখেননি, শুধু উল্লেখ করেছেন যে, এটি একটি “দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা” ছিল, যা অর্কের মনে সন্দেহ জাগিয়েছিল, যেন এর পেছনে কিছু লুকানো আছে। ম্যাকনিল তার গবেষণায় উইন্ডসর হাউসের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কিছু স্থানীয় লোককথা উল্লেখ করেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল যে ভিলাটি একটি “দুষ্ট আত্মার” বাসস্থান। কিন্তু ম্যাকনিল সেগুলোকে “অন্ধবিশ্বাস” বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার লেখায় এক অদ্ভুত অস্থিরতা ছিল, যেন তিনি নিজেই বিশ্বাস করতে চাননি যা তিনি দেখেছেন, যেন তিনি নিজেই সেই ভয়ের শিকার হয়েছিলেন, তার নিজের লেখা যেন তাকেই তাড়া করছিল, তাকে পাগল করে দিচ্ছিল। তার লেখাগুলো যেন তার মানসিক অশান্তির প্রতিফলন, এক উন্মাদনার পূর্বাভাস, এক ভয়ঙ্কর সত্যের ইঙ্গিত, যা তার জীবনকেও প্রভাবিত করেছিল, তাকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছিল, তাকে এক নতুন, অন্ধকার পথে ঠেলে দিয়েছিল। অর্কের মনে হল, ম্যাকনিল হয়তো পুরো সত্যটা জানতে পারেননি, অথবা তিনি প্রকাশ করতে চাননি, কোনো এক অদৃশ্য চাপে তিনি হয়তো নীরব ছিলেন, তার কলমও যেন বাধাগ্রস্ত ছিল। তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধল। এলিজাবেথের মৃত্যু কি সত্যিই নিছকই দুর্ঘটনা ছিল? কেন ম্যাকনিল এই বিষয়ে এত সংক্ষিপ্ত ছিলেন? এই সব প্রশ্ন অর্ককে আরও গভীরে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করল, তার অনুসন্ধানী মন জেগে উঠল। সে ড. ম্যাকনিলের সম্পর্কে আরও তথ্য খুঁজতে শুরু করল। জানতে পারল, তিনি এখন আর জীবিত নেই, একটি রহস্যময় মানসিক অসুস্থতায় ভুগতে ভুগতে তার মৃত্যু হয়েছিল, যা তার শেষ জীবনে তাকে উন্মাদ করে তুলেছিল, তার শেষ দিনগুলি ছিল বিভীষিকাময়, যন্ত্রণাময়। তার কিছু বই এবং অপ্রকাশিত গবেষণা পত্র কলকাতার একটি পুরনো লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে, যা হয়তো সেই রহস্যের আরও গভীর তথ্য বহন করছে, এক অশুভ সত্যের ইঙ্গিত, এক ভয়ঙ্কর পরিণতি, যা অর্কেরও হতে পারে, তার জীবনও সেই একই পথে যেতে পারে, এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে তার কোনো মুক্তি নেই। অর্ক সিদ্ধান্ত নিল, তাকে কলকাতা যেতে হবে। এই রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। তার মনে হচ্ছিল, এই ভয়ের পেছনে হয়তো আরও বড় কোনো সত্য লুকিয়ে আছে, যা এলিজাবেথের পিয়ানোর সুরের থেকেও ভয়ঙ্কর, যা তার জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছে। চলবে…

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion