কলকাতার লাইব্রেরিতে গুপ্ত সত্যের সন্ধান
কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির বিশাল, ধুলোমাখা করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অর্কের মনে হলো, সে যেন সময়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছে, এক প্রাচীন ও অজানা জগতে প্রবেশ করছে, যেখানে প্রতিটি ধুলোর কণায় ইতিহাস আর রহস্য লুকিয়ে আছে, প্রতিটি বইয়ের তাকে জমাট বেঁধে আছে শত শত বছরের গোপন কথা, যা এখন তার কাছে উন্মোচিত হচ্ছে, এক ভয়ঙ্কর সত্য, এক প্রাচীন অভিশাপ, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নীরব ছিল, তার অস্তিত্বের গভীরে। পুরনো বইয়ের গন্ধ, আর কাগজের পাতা উল্টানোর মৃদু শব্দ এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছে, যা একাধারে রহস্যময় এবং ভীতিকর, যেন অতীত তাকে তার কাছে টেনে নিচ্ছে, তাকে গ্রাস করতে চাইছে, তার আত্মাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইছে, তাকে তার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য করছিল, তাকে পাগল করে দিচ্ছিল। লাইব্রেরির এক কোণে একটি পুরনো কাঠের টেবিলের উপর বসে সে ড. অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকনিলের অপ্রকাশিত কিছু গবেষণা পত্র খুঁজে বের করল। এই কাগজপত্রগুলো খুব কম মানুষই ঘেঁটেছে, কারণ এগুলো সাধারণ মানুষের আগ্রহের বিষয় নয়, বরং এক বিশেষ শ্রেণির গবেষকদের জন্য সংরক্ষিত, যারা রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে চায়, যারা সত্যের অনুসন্ধানে নিজের জীবন বাজি রাখে, যারা অন্ধকারকে ভয় পায় না, যারা জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। এখানে প্রবেশ করতেই অর্কের মনে হলো, কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে, তার প্রতিটি নড়াচড়া অদৃশ্য চোখে পর্যবেক্ষণ করছে। বইয়ের তাকের ফাঁক থেকে যেন অস্পষ্ট মুখ উঁকি মারছে, তাদের চোখ থেকে এক স্থির দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ, যেন তারা তার প্রতিটি ভাবনা পড়ছে, তার মনের গভীরতম কোণায় প্রবেশ করতে চাইছে, তার ভয়কে আরও বাড়িয়ে তুলছে, তাকে এক অকল্পনীয় আতঙ্কে ডুবিয়ে দিচ্ছিল। লাইব্রেরির বাতাস অদ্ভুতভাবে ভারী ছিল, যেন প্রতিটি ধুলোর কণায় শত বছরের পুরনো ইতিহাস আর গোপন কথা মিশে আছে, আর তাদের প্রতিটি শব্দ যেন তার কানের পাশে ফিসফিস করে কিছু বলছে, তাকে এক অজানা ভয়ের বার্তা দিচ্ছে, তাকে সাবধান করছে, তাকে পিছিয়ে যেতে বলছে, তাকে রক্ষা করতে চাইছে, এক অশরীরী সতর্কবার্তা।
একটি পুরনো লাল রঙের ফাইলে ম্যাকনিলের কিছু হ্যান্ডনোট আর চিঠিপত্র পাওয়া গেল। ফাইলটি খুলতেই এক তীব্র, চাপা গন্ধ তার নাকে এলো, যেন পুরনো কাগজ নয়, বরং মৃত ঘাসের গন্ধ, যা তার মনকে এক গভীর হতাশায় ডুবিয়ে দিল, তার শরীরকে শীতল করে তুলল, তার শিরায় শিরায় রক্ত যেন জমাট বাঁধছে, তার হৃদপিণ্ড যেন জমে যাচ্ছে, তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। এর মধ্যে একটি চিঠি অর্কের দৃষ্টি আকর্ষণ করল, যার কোণগুলো পুরনো রক্ত-মোরগের মতো লাল হয়ে গেছে, আর কাগজগুলো ভঙ্গুর হয়ে এসেছিল, যেন এক স্পর্শেই ভেঙে যাবে, তার প্রাচীনত্বের সাক্ষী। চিঠিটি ম্যাকনিল লিখেছিলেন তার এক সহকর্মীকে, যিনি একজন প্যারা-সাইকোলজিস্ট ছিলেন। চিঠিতে ম্যাকনিল উইন্ডসর হাউসের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছিলেন যে, তার গবেষণার সময় তিনি ভিলাতে কয়েকদিন ছিলেন এবং সেখানে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা অনুভব করেছিলেন। তিনি পিয়ানোর আওয়াজ, ঘরের মধ্যে হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া এবং কিছু ছায়া দেখার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। চিঠিতে ম্যাকনিল স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি প্রথমে এই সব ঘটনাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে তিনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, উইন্ডসর হাউস সত্যিই ভূতুড়ে। তার হাতের লেখা কাঁপছিল, যেন তিনি ভয়ে ভয়ে লিখছিলেন, প্রতিটি শব্দেই এক গভীর ভয়ের ছাপ স্পষ্ট, যেন তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতার ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে চাইছিলেন, তার মন সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, তার শেষ জীবন এক উন্মাদনায় কেটেছিল, সে একজন জীবন্ত প্রেতাত্মা হয়ে গিয়েছিল, তার আত্মা পচে গিয়েছিল।
কিন্তু চিঠির শেষ প্যারাটা অর্ককে স্তম্ভিত করে দিল, তার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল, তার হৃদপিণ্ড যেন থেমে গেল, তার চারপাশে যেন এক নিস্তব্ধতা নেমে এলো, যেন মৃত্যু তাকে স্পর্শ করেছে, তার অস্তিত্বকে গ্রাস করতে চাইছে। ম্যাকনিল লিখেছিলেন যে, এলিজাবেথের মৃত্যুর পর মিস্টার জনসন আর বেশিদিন ভিলাতে থাকেননি। তিনি দ্রুত ভিলাটি বিক্রি করে দেন এবং দেশে ফিরে যান। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি ছিল, জনসন পরিবারের একজন প্রাচীন চাকর, যার নাম ছিল ‘বৃদ্ধ গোঁসাই’, ম্যাকনিলকে বলেছিলেন যে এলিজাবেথকে নাকি “পৃথিবীর নিচের শক্তি” নিয়ে গেছে। এই “পৃথিবীর নিচের শক্তি” কী, তা ম্যাকনিল তার চিঠিতে উল্লেখ করেননি, কিন্তু এর থেকেই বোঝা যায় যে এলিজাবেথের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা ছিল না, বরং এক অশুভ শক্তির শিকার। এই অংশটা পড়তেই লাইব্রেরির সেই কোণটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল, আর অর্কের মনে হলো তার কানের পাশ দিয়ে শীতল বাতাস বয়ে গেল, যেন কেউ তার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কিছু বলছে, তার কানের কাছে সেই অশুভ শক্তি শ্বাস ফেলছে, তার ভেতরের ভয়কে আরও বাড়িয়ে তুলছে, তাকে এক অস্থির জগতে ঠেলে দিচ্ছিল, তার sanity কেড়ে নিচ্ছিল, তাকে পাগল করে দিতে চাইছিল, তাকে এক জীবন্ত নরকে ঠেলে দিচ্ছিল।
অর্ক আরও খুঁজতে লাগল। সে জনসন পরিবারের বংশপরিচয় জানার চেষ্টা করল। জানতে পারল, মিস্টার জনসনের পরিবার ইংল্যান্ডের একটি প্রাচীন অভিজাত পরিবার ছিল, যাদের পারিবারিক ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। কিন্তু তাদের ইতিহাসে এমন কোনো উল্লেখ পাওয়া গেল না যা ভূতুড়ে ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে এই পরিবারে কিছু অদ্ভুত রোগের উল্লেখ ছিল, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে আসছিল, এবং তাদের মধ্যে কিছু সদস্যের অকালমৃত্যুও হয়েছিল। ম্যাকনিলের লেখা একটি অপ্রকাশিত নোটে এই রোগের উল্লেখ ছিল – “একটি মানসিক ক্ষয়, যা স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মধ্যে বিভেদ মুছে দেয়, এবং শেষ পর্যন্ত আত্মাকে গ্রাস করে।” অর্কের মনে হলো, এই রোগ হয়তো সেই ‘পৃথিবীর নিচের শক্তি’রই ফল, যা জনসন পরিবারকে অভিশপ্ত করেছিল, তাদের জীবনকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দিয়েছিল, তাদের রক্তে মিশে গিয়েছিল, তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছিল, তাদের বংশকে অভিশপ্ত করেছিল।
এরপর অর্ক এলিজাবেথের মৃত্যুর সাল, ১৮৮৮ সালের কালিম্পং-এর স্থানীয় সংবাদপত্র খুঁজতে শুরু করল। লাইব্রেরির একজন অভিজ্ঞ কর্মী তাকে সাহায্য করলেন। বেশ কয়েকটি পুরনো খবরের কাগজের পাতা উল্টানোর পর, একটি ছোট খবর অর্কের চোখে পড়ল। খবরটি ছিল, “উইন্ডসর হাউসে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা: মিসেস এলিজাবেথ জনসনের মৃত্যু।” খবরটিতে লেখা ছিল যে, মিসেস জনসন সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন। পুলিশ এটিকে একটি দুর্ঘটনা বলেই গণ্য করেছে। কিন্তু অর্কের মনে হলো, এই খবরটা খুব সাধারণ এবং সংক্ষিপ্ত। কোনো বিস্তারিত তথ্য নেই, যা সাধারণত এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনার ক্ষেত্রে থাকে। খবরের প্রতিটি শব্দ যেন মিথ্যা বলছে, যেন একটা বড় সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ, যা বহু বছর ধরে লুকিয়ে ছিল, এবং এখনও তার প্রভাব বিস্তার করছে, যারা এই খবর পড়বে তাদের জীবনে।
খবরের কাগজের ঠিক পরের পৃষ্ঠায় একটি ছোট বিজ্ঞাপন ছিল। বিজ্ঞাপনটি ছিল “মিস্টার জনসন কর্তৃক উইন্ডসর হাউস বিক্রির প্রস্তাব।” এলিজাবেথের মৃত্যুর ঠিক পরেই ভিলাটি বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, যেন তিনি এক মুহূর্তও সেখানে থাকতে চাননি, যেন সেই স্থানটি তার কাছে নরকে পরিণত হয়েছিল। এটা অর্কের সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে দিল। যদি এটি নিছকই দুর্ঘটনা হতো, তাহলে মিস্টার জনসন এত দ্রুত ভিলাটি বিক্রি করতে চাইতেন কেন? এই আচরণটা স্বাভাবিক ছিল না, বরং এক গভীর ভয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। অর্কের মনে হলো, মিস্টার জনসন হয়তো কিছু লুকাতে চেয়েছিলেন, এমন কিছু যা এত বছর পরও তাদের অনুসরণ করছে, আর এখন অর্কের জীবনেও প্রবেশ করেছে, তাকেও সেই অভিশাপের শিকার করতে চাইছে, তাকেও সেই অন্ধকারে টেনে নিতে চাইছে, তাকেও সেই একই পরিণতি ভোগ করতে হবে, তার আত্মাকে গ্রাস করতে চাইছে।
তার মনে হল, বৃদ্ধ গোঁসাইয়ের কথাটি হয়তো সত্যি। এলিজাবেথের মৃত্যু কি কোনো অলৌকিক শক্তির ফল ছিল? এই “পৃথিবীর নিচের শক্তি” আসলে কী? এই প্রশ্নগুলো অর্ককে আরও অস্থির করে তুলল। সে বুঝতে পারল, এই রহস্যের সমাধান কালিম্পং-এ ফিরে গিয়েই করতে হবে। তাকে উইন্ডসর হাউসের গভীরে প্রবেশ করতে হবে, সেই “পৃথিবীর নিচের শক্তি” কী, তা জানতে হবে। তার মনে হল, হয়তো সেই শক্তিই পিয়ানোর সুরের মাধ্যমে এলিজাবেথের আত্মাকে আটকে রেখেছে, আর সেই শক্তিই তাকে বারবার উইন্ডসর হাউসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এক অদৃশ্য টানে, এক অনিবার্য নিয়তির দিকে, যা তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে, তার আত্মাকে গ্রাস করবে, তাকে চিরতরে বিলীন করে দেবে, তাকে তার নিজের অস্তিত্ব থেকে মুছে দেবে, তাকে এক নরকে পরিণত করবে, যেখানে কোনো মুক্তি নেই।
চলবে…..
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion