Episode 7640 words0 views

অভিশপ্ত পিয়ানো : সপ্তম অধ্যায়

সুকান্ত সাংবাদিকের আবির্ভাব অর্ক বুঝতে পারছিল, এই রহস্যের গভীরে একা প্রবেশ করাটা সম্ভব নয়। তার প্রয়োজন একজন সহকর্মী, একজন যিনি এই অলৌকিক জগতের গভীরে প্রবেশ করার সাহস রাখেন এবং একই সাথে যুক্তিবাদী মন নিয়ে সত্যের অনুসন্ধান করতে পারেন। তার মনে পড়ল, অনলাইন ফোরামে একজন ব্যক্তি “সুকান্ত সাংবাদিক” নামে পরিচিত ছিলেন। শিলিগুড়ির স্থানীয় পত্রিকায় সুকান্ত প্রায়ই ঐতিহাসিক ও লোককথাভিত্তিক কলাম লিখতেন, যেখানে তিনি অনেক সময় অজানাকে উন্মোচনের চেষ্টা করতেন, যদিও তার লেখায় এক ধরণের বুদ্ধিজীবীসুলভ সংশয়বাদ থাকত। অর্ক দেখল, সুকান্ত উইন্ডসর হাউসের থ্রেডে একাধিক পোস্ট করেছেন, প্রতিটি পোস্টে তার গভীর গবেষণা এবং স্থানীয় লেপচা উপজাতির লোককথা সম্পর্কে তার ব্যাপক জ্ঞান ফুটে উঠেছে। সুকান্তের এক পোস্টে লেখা ছিল, “আমি উইন্ডসর হাউসের রহস্য নিয়ে অনেকদিন ধরেই অনুসন্ধান করছি। স্থানীয় লেপচারা এই স্থানটিকে ‘বাতা-ফোলা’র প্রবেশদ্বার বলে জানে, যার অর্থ ‘পাতালের প্রবেশপথ’। তাদের প্রাচীন পুঁথিতে এই স্থানের এক ভয়ঙ্কর শক্তির উল্লেখ আছে। যদিও আমি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, তবু এই গল্পগুলোর পেছনে হয়তো কোনো সত্য লুকিয়ে আছে, যা আমাদের যুক্তির বাইরে। যারা সেখানে অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করেছেন, তারা আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।” এই পোস্টটি অর্কের মনে এক নতুন আশার সঞ্চার করল। সে একা নয়, এমন আরও কেউ আছে যে এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক। অর্ক তখনই সুকান্তের সাথে ব্যক্তিগত মেসেজে যোগাযোগ করল, তার নিজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা খুলে লিখল। কয়েক ঘণ্টা পর সুকান্তের উত্তর এলো। সুকান্ত অর্কের কাহিনী শুনে প্রথমে বেশ সংশয়ী হলেও, অর্কের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং তার দেওয়া ম্যাকনিলের তথ্যের উল্লেখ তাকে আগ্রহী করে তুলল। সুকান্ত তার পরের মেসেজে লিখলেন, “আপনার অভিজ্ঞতা সত্যি যদি হয়, তাহলে এই রহস্য আরও গভীর। আমি কালিম্পং-এর কিছু পুরনো লোকজনের সাথে কথা বলেছিলাম, তারা সবাই এই ভিলাকে এড়িয়ে চলে। আমি স্থানীয় উপজাতিদের একজন গুরুজির সাথেও পরিচিত, যিনি এই ধরনের প্রাচীন জ্ঞান এবং আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। আমি মনে করি, আপনার এবং আমার এই মিলিত অনুসন্ধান হয়তো এই রহস্যের সমাধান করতে পারবে। আমরা শিলিগুড়িতে একটি ক্যাফেতে দেখা করতে পারি, যদি আপনি ইচ্ছুক হন।” অর্ক এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে রাজি হয়ে গেল। এইবার সে একা নয়, তার সাথে একজন যুক্তিবাদী, সাহসী সাংবাদিক আছেন। এই দুইজনের মিলিত শক্তি হয়তো সেই অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করতে পারবে, যার সঙ্গে অর্ক একা পেরে ওঠেনি। সুকান্ত সাংবাদিকের সাথে অর্কের প্রথম দেখা হলো শিলিগুড়ির একটি ছোট, নিরিবিলি ক্যাফেতে। ক্যাফেটির চারপাশে পুরনো বই আর ছবির ভিড়, যেন অতীতের এক নিস্তব্ধ অংশ, যা তাদের আলোচনার জন্য এক উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছিল। সুকান্তকে দেখে অর্ক প্রথমটায় একটু অবাক হলো। সে ভেবেছিল, একজন সাংবাদিক হয়তো কিছুটা রাশভারী হবেন, কিন্তু সুকান্তের চোখে ছিল এক অদ্ভুত কৌতূহল এবং উষ্ণতা, তার মুখে ছিল এক মৃদু হাসি। সুকান্তের বয়স প্রায় অর্কের কাছাকাছি, হয়তো দু-এক বছরের বড়। তার পরিধানে একটি সাধারণ জিন্স আর টি-শার্ট, যা তার পেশার সাথে কিছুটা বেমানান লাগছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল এক গভীর বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি, যা তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে নির্দেশ করছিল। সুকান্তের চুলগুলো এলোমেলো, যেন সে চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে নিজের চুল নিজেই এলোমেলো করে ফেলেছিল, আর তার হাতে ছিল একটি ছোট নোটবুক আর পেন, যেন সে যেকোনো মুহূর্তে কিছু লিখতে প্রস্তুত। অর্ক তার উইন্ডসর হাউসের অভিজ্ঞতা এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে পাওয়া ম্যাকনিলের চিঠিপত্র ও অন্যান্য তথ্য বিস্তারিতভাবে সুকান্তকে জানাল। সুকান্ত মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, মাঝে মাঝে নিজের নোটবুকে কিছু লিখছিলেন, তার ভুরু কুঁচকে যাচ্ছিল গভীর চিন্তায়। যখন অর্ক বৃদ্ধ গোঁসাইয়ের “পৃথিবীর নিচের শক্তি”র কথা বলল, তখন সুকান্তের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠল। “বাতা-ফোলা!” তিনি প্রায় ফিসফিস করে উঠলেন, “আমি জানতাম, এই ভিলার সাথে লেপচাদের প্রাচীন লোককথা জড়িত! আমি এই ‘বাতা-ফোলা’ সম্পর্কে অনেক শুনেছি, কিন্তু তার গভীরতায় কখনো প্রবেশ করতে পারিনি। এই শক্তি সম্পর্কে লেপচাদের বিশ্বাস অত্যন্ত দৃঢ়, তারা একে শ্রদ্ধা করে এবং ভয় পায়।” সুকান্ত এরপর নিজের কিছু অনুসন্ধান এবং কালিম্পং-এর স্থানীয় লোককথা সম্পর্কে অর্ককে বললেন। তিনি জানালেন, তিনি বহুদিন ধরেই কালিম্পং-এর লোককথা নিয়ে কাজ করছেন, বিশেষ করে যেসব গল্পে অতিপ্রাকৃতের ছোঁয়া আছে। অর্ক বুঝতে পারল, সুকান্তের সাহায্য কতটা জরুরি। সুকান্ত কেবল একজন সাংবাদিক নন, বরং তিনি একজন সহযোগী, একজন বন্ধু, যিনি এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে প্রস্তুত। সুকান্তই অর্ককে লেপচা সম্প্রদায়ের গুরুজি টেনজিং লামার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। অর্ক এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে রাজি হয়ে গেল। চলবে….

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion