গুরুজি টেনজিং লামার রহস্য উন্মোচন
পরের দিন অর্ক আর সুকান্ত দুজনেই গুরুজি টেনজিং লামার বাড়ির দিকে যাত্রা করল। পথটি ছিল নির্জন, চারদিকে ঘন বন আর পাখির অদ্ভুত কিচিরমিচির শব্দ, যা সাধারণ শব্দ ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল যেন অশুভ কোনো বার্তা বহন করে আনছে, তাদের কানের কাছে অস্ফুটে কিছু বলছে, তাদের কপালে শীতল বাতাস লাগছে, তাদের মনকে অস্থির করে তুলছে, তাদের এক অজানা ভয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তাদের সাবধান করছিল, তাদের ফিরে যেতে বলছিল, কিন্তু তারা ফিরে যেতে পারছিল না। এইবার অর্ক একা ছিল না, তার পাশে সুকান্তের মতো একজন দৃঢ়চেতা মানুষ ছিল, যা তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছিল।
গুরুজি টেনজিং লামা একজন বৃদ্ধ, শান্ত প্রকৃতির মানুষ। তার পরনে সাদা ধুতি, মুখে লম্বা শ্মশ্রু, আর চোখে এক অদ্ভুত শান্ত গভীরতা, যা হাজার বছরের রহস্য বহন করছিল, যেন তিনি সময়ের সাথে সাথে বহু অজানা সত্য দেখেছেন, এবং এই জগতের বাইরেও এক জগতের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন। অর্ক ও সুকান্ত গুরুজির কাছে গিয়ে উইন্ডসর হাউসের অর্কের অভিজ্ঞতা, ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে পাওয়া তথ্য এবং “পৃথিবীর নিচের শক্তি” বা “বাতা-ফোলা” সম্পর্কে তাদের সমস্ত অনুসন্ধান বিস্তারিতভাবে খুলে বলল। গুরুজি মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন, তার মুখে কোনো বিস্ময় বা অবিশ্বাস দেখা গেল না। মনে হলো, তিনি যেন এই সব কিছু আগেই জানতেন, এবং বহু বছর ধরে এই দিনের অপেক্ষা করছিলেন, যখন কেউ এই রহস্য উন্মোচন করতে আসবে, এবং তার সাথে এই যুদ্ধে যোগ দেবে, এক প্রাচীন লড়াইয়ে, যা মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা হয়তো বহু আত্মার মুক্তি দেবে, তাদের চিরন্তন যন্ত্রণার অবসান ঘটাবে।
সব শুনে গুরুজি মৃদু হেসে বললেন, “উইন্ডসর হাউস। এর আসল নাম ‘মৃতের প্রাসাদ’। ব্রিটিশরা এর নাম বদলেছিল, কিন্তু এর ইতিহাস আরও অনেক পুরনো। তোমার অভিজ্ঞতা সত্যি, অর্ক। এলিজাবেথের আত্মা সেখানেই বন্দি। তবে শুধু এলিজাবেথ নয়, আরও অনেক আত্মা সেখানে আটকে আছে, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুক্তির অপেক্ষায় আছে, তাদের আর্তনাদ সেখানকার বাতাসকে ভারী করে তুলেছে, তাদের উপস্থিতি প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করা যায়, এক ভয়ঙ্কর সত্য, যা সাধারণ মানুষ ধারণাও করতে পারে না, যা তাদের মস্তিষ্ককে বিকৃত করে দিতে পারে।”
সুকান্ত, তার সাংবাদিকসুলভ কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মৃতের প্রাসাদ? এর মানে কী, গুরুজি? কেন এমন নাম? এর কি কোনো প্রাচীন ইতিহাস আছে? এর পেছনে কি কোনো ভয়ঙ্কর গল্প লুকিয়ে আছে? কোনো নিষিদ্ধ আচার? এর কোনো অভিশাপ আছে? এই স্থানটি কি সত্যিই অভিশপ্ত? আর ‘বাতা-ফোলা’ কী?”
গুরুজি ব্যাখ্যা করলেন, “এই ভিলাটি যে জমির ওপর তৈরি, তা একসময় স্থানীয় লেপচা উপজাতির একটি পবিত্র সমাধিস্থল ছিল। লেপচা লোককথা অনুযায়ী, এই স্থানটি কেবল সমাধিস্থল ছিল না, বরং এটি ছিল ‘বাতা-ফোলা’-এর প্রবেশদ্বার। বাতা-ফোলা মানে ‘পাতালের প্রবেশপথ’, যেখানে পৃথিবী এবং অন্য জগতের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম প্রাচীর থাকে, যা দিয়ে মৃত আত্মারা এই জগতে প্রবেশ করতে পারে। তারা বিশ্বাস করত, ওই স্থানটি পৃথিবীর নিচেকার এক বিশেষ শক্তির প্রবেশদ্বার, যা জীবিত এবং মৃতদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে, এক নিষিদ্ধ জ্ঞান দেয়, কিন্তু এর জন্য এক ভয়াবহ মূল্য চোকাতে হয়, যা তাদের জীবন কেড়ে নিতে পারে, তাদের আত্মাকে গ্রাস করতে পারে। যখন ব্রিটিশরা আসে এবং এই জমিতে ভিলা তৈরি করে, তারা সেই পবিত্রতা ভঙ্গ করে, তাদের লোভের বশবর্তী হয়ে, এই প্রাচীন স্থানটিকে অপমান করে, এর পবিত্রতাকে নষ্ট করে দেয়। লেপচারা তাদের দেবতাদের পূজা করত এবং তাদের আত্মাদের শান্তি দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করত, যাতে পাতালের শক্তি জেগে না ওঠে। ব্রিটিশরা সেই সব বন্ধ করে দেয়, তাদের নিজেদের স্থাপত্য আর জীবনযাপন চাপিয়ে দেয়, আর এর ফলস্বরূপ সেই ‘পৃথিবীর নিচের শক্তি’ জেগে ওঠে, যা এখন ক্ষুধার্ত দানবের মতো সব কিছু গ্রাস করছে, তার অন্ধকার প্রভাব ছড়িয়ে দিচ্ছে, তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে মৃত্যু মিশে আছে, তার উপস্থিতিতে জীবনশক্তি বিলীন হয়ে যায়, গাছপালা শুকিয়ে যায়, মাটি বিষাক্ত হয়ে ওঠে, প্রাণী মারা যায়, এমনকি বাতাসও বিষাক্ত হয়ে ওঠে।”
“এলিজাবেথের মৃত্যু কি সেই শক্তিরই ফল?” অর্ক জানতে চাইল, তার গলা শুকিয়ে কাঠ, তার শরীর ভয়ে কাঁপছে, তার ভেতরে এক শীতলতা অনুভব করছে।
“হ্যাঁ,” গুরুজি মাথা নাড়লেন, “এলিজাবেথ ছিলেন একজন সংবেদনশীল আত্মা, যার মন ছিল শিল্প আর সঙ্গীতের প্রতি নিবেদিত। তার অদম্য সৃজনশীলতা, বিশেষত সঙ্গীতে তার গভীর নিমগ্নতা, তাকে প্রকৃতির সূক্ষ্ম স্পন্দনগুলি অনুভব করতে সাহায্য করত। কিন্তু তার ভেতরে যে গভীর বিষণ্ণতা আর অপ্রাপ্তির শূন্যতা ছিল, বিশেষত সন্তানহীনতার কষ্ট, তা তাকে আরও বেশি সংবেদনশীল করে তুলেছিল, এবং এই শূন্যতাই যেন ছিল এক অদৃশ্য ফাটল, যার মধ্য দিয়ে সেই অশুভ শক্তি তার আত্মায় প্রবেশ করেছিল। ‘পৃথিবীর নিচের শক্তি’ তার এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়। পিয়ানো বাজানো ছিল তার ভালোবাসার জিনিস, তার দুঃখ প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম। আর সেই ভালোবাসাই তার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ সেই শক্তি পিয়ানোটিকে তার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। পিয়ানোটি যেন সেই শক্তির একটি যন্ত্র হয়ে ওঠে, যার মাধ্যমে এলিজাবেথের আত্মাকে ধীরে ধীরে বন্দি করা হয়েছিল, যেন এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল, আর তার সুর পরিণত হয়েছিল এক করুণ আর্তনাদে, এক অবরুদ্ধ আত্মার চিৎকার, যা চিরকাল সেখানে অনুরণিত হবে, যারা শুনবে তাদের মনকে পীড়িত করবে, তাদের আত্মাকে গ্রাস করতে চাইবে, তাদের sanity কেড়ে নিতে চাইবে, তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করতে চাইবে। সেই সুরের প্রতিটি নোটে এলিজাবেথের ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, তার হতাশা এবং সেই অশুভ শক্তির পৈশাচিক আনন্দ মিশে থাকত, যা তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যেত, তাকে উন্মাদনার দিকে ঠেলে দিত। মিস্টার জনসন এই সব জানতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার স্ত্রীর মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা ছিল না, বরং এক ভয়াবহ অশুভ শক্তির কাজ। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘পৃথিবীর নিচের শক্তি’র অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন। তিনি ভয় পেয়েছিলেন এবং তাই দ্রুত ভিলা বিক্রি করে চলে যান। কিন্তু তিনি তার স্ত্রীর আত্মাকে মুক্ত করতে পারেননি। সেই বোঝা তাকে সারা জীবন বহন করতে হয়েছে, আর সম্ভবত সেই মানসিক ক্ষয় রোগটি তারই পরিবারের অভিশাপ ছিল, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল, তাদের রক্তে মিশেছিল, তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।”
অর্ক জানতে চাইল, “তাহলে এখন কী করা যাবে? কিভাবে এলিজাবেথের আত্মাকে মুক্ত করা যাবে? আমরা কি সেই অশুভ শক্তির সাথে যুদ্ধ করব? তার শক্তি কি অনেক বেশি? আমরা কি আদৌ সফল হতে পারব? আমাদের কি জীবনের ঝুঁকি নেওয়া উচিত?” সুকান্তও গুরুজির দিকে তাকিয়ে ছিল, তার চোখে জিজ্ঞাসা।
গুরুজি বললেন, “সেই শক্তির সঙ্গে সরাসরি লড়াই করা সম্ভব নয়। সে অনন্ত। তার শক্তি মানবজাতির কল্পনার বাইরে। কিন্তু আমরা কিছু আচার-অনুষ্ঠান করতে পারি, যা এলিজাবেথের আত্মাকে মুক্তি দিতে সাহায্য করবে। তবে এর জন্য ভিলাতে প্রবেশ করতে হবে এবং সেই পিয়ানোটির কাছে যেতে হবে। সেখানে আমাদের জীবনের ঝুঁকি থাকতে পারে, কারণ সেই শক্তি এখন ক্ষুধার্ত, সে নতুন আত্মাকে নিজের দখলে নিতে চাইবে, তার রাজ্যকে আরও শক্তিশালী করতে চাইবে, এবং যে কেউ তাকে বাধা দেবে, তাকেই সে গ্রাস করবে, তার আত্মাকে চিরতরে বন্দি করবে, তাকে তার দাসে পরিণত করবে, তাকে এক জীবন্ত নরকে ঠেলে দেবে।”
অর্ক দ্বিধায় পড়ে গেল। সে উইন্ডসর হাউসের ভয়াবহতা নিজ চোখে দেখে এসেছে। তার শরীরের প্রতিটি কোষে সেই ভয়ের অনুভূতি এখনও লেগে আছে। কিন্তু এলিজাবেথের করুণ সুর এবং তার বন্দি আত্মার কথা শুনে তার মনে এক ধরনের সহানুভূতি জাগল, যা তার ভয়কে ছাপিয়ে গেল, তার মধ্যে এক নতুন সংকল্প জন্ম দিল, এক অদম্য সাহস, এক অদম্য ইচ্ছা। সে গুরুজির দিকে তাকাল এবং দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি যাব। আমি এলিজাবেথকে মুক্ত করতে চাই, যতই বিপদ আসুক, আমি প্রস্তুত। আমি এই অভিশাপের শেষ দেখতে চাই, এই স্থানটিকে মুক্ত করতে চাই, এর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে চাই, আর কোনো আত্মাকে এখানে বন্দি হতে দেব না, আমি এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।” সুকান্ত অর্কের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, তার চোখেও দৃঢ়তা, যেন সেও এই সত্য উন্মোচনের জন্য যেকোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত।
গুরুজি তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, কিন্তু তার চোখে এক কঠিন সংকল্প ছিল। “জেনে রাখো, এটি বিপজ্জনক কাজ। সেই শক্তি খুব সহজে তার শিকারকে ছাড়তে চাইবে না। সে তোমাকে তার রাজ্যে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে, তোমার মনকে বিভ্রান্ত করবে, তোমাকে ভয় দেখাবে, তোমার আত্মাকে গ্রাস করতে চাইবে, তোমাকে তার কাছে টেনে নেবে, তোমাকে চিরতরে তার দাসে পরিণত করতে চাইবে। কিন্তু যদি আমরা সফল হই, তাহলে শুধু এলিজাবেথ নয়, আরও অনেক বন্দি আত্মা মুক্তি পাবে, আর এই স্থানটি হয়তো আবার শান্ত হবে, তার হারানো পবিত্রতা ফিরে পাবে, আর বাতা-ফোলা’র প্রবেশপথ হয়তো চিরতরে বন্ধ হবে, এই অন্ধকার চিরতরে বিলীন হবে, আর শান্তি ফিরে আসবে, যা এই স্থানটি বহু বছর ধরে পায়নি।”
গুরুজি এরপর একটি প্রাচীন বই বের করলেন, যা লেপচা ভাষায় লেখা। বইটি ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের আচার-অনুষ্ঠান এবং পবিত্র স্থান সম্পর্কিত। সেই বইয়ের পাতাগুলো পুরনো রক্ত আর কালির দাগে ভরা ছিল, যেন প্রতিটি পাতায় এক অজানা ইতিহাস লুকিয়ে আছে, প্রতিটি শব্দে যেন এক প্রাচীন মন্ত্রের শক্তি ছিল। তিনি সেই বই থেকে কিছু মন্ত্র এবং পূজার পদ্ধতি অর্ক ও সুকান্তকে বুঝিয়ে দিলেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল, পরের দিন রাতে উইন্ডসর হাউসে যাবে এবং সেখানে বিশেষ এক ধরনের পূজা ও মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে এলিজাবেথের আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করবে। এইবার, অর্ক একা ছিল না। তার সাথে ছিলেন একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, যিনি এই অলৌকিক জগতের গভীরে প্রবেশ করার সাহস রাখতেন, আর একজন যুক্তিবাদী সাংবাদিক, যিনি সত্যের অনুসন্ধানে বদ্ধপরিকর। তাদের এই যাত্রা কি সফল হবে? নাকি উইন্ডসর হাউসের অভিশাপ তাদেরও গ্রাস করবে, তাদের আত্মাকেও চিরতরে বন্দি করবে সেই মৃতের প্রাসাদে, বাতা-ফোলা’র অনন্ত অন্ধকারে? এই প্রশ্নটি অর্ক ও সুকান্তের মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল, তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছিল, তাদের এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, যেখানে তাদের ভাগ্য সুতোর ওপর ঝুলছিল, তাদের জীবন এক চরম পরীক্ষায় ছিল।
চলবে…
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion