বন্ধুত্ব, প্রেম ও সুরভির পরীক্ষা
কিন্তু নিয়তির খেলা বড়ই অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত। একদিন, ক্লাসের বিজ্ঞানের শিক্ষক একটি কঠিন প্রোজেক্ট দিলেন, যা দুজন করে ছাত্রকে একসঙ্গে করতে হতো। নিয়তির নির্দেশে, আকাশ আর দিশাকে একসঙ্গে কাজ করতে দেওয়া হলো। দিশা প্রথমে কিছুটা অবাক হয়েছিল। আকাশ ছিল শান্ত এবং লাজুক, ক্লাসে সে খুব বেশি কথা বলতো না, সবসময় বই নিয়ে থাকতো, যেন সে অদৃশ্য থাকতে চাইতো। আর দিশা ছিল চটপটে, উদ্যমী এবং সকলের সাথে খোলামেলা। কিন্তু যখন তারা প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করলো, দিশা আকাশের গভীর জ্ঞান, সূক্ষ্ম বুদ্ধি আর অসাধারণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। আকাশের প্রতিটি ব্যাখ্যা ছিল সহজবোধ্য এবং যুক্তিযুক্ত, যা দিশাকে অবাক করে দিল। সে ভাবতেই পারেনি, এমন শান্ত একটি ছেলের এত জ্ঞান থাকতে পারে, এত গভীর চিন্তাভাবনা থাকতে পারে। আকাশও দিশার সরলতা, তার কর্মঠ মনোভাব এবং বুদ্ধিমত্তা দেখে অভিভূত হলো। দিশা শুধুমাত্র সুন্দরী ছিল না, সে ছিল অত্যন্ত মেধাবী এবং পরিশ্রমী, যেকোনো কাজ সে মন দিয়ে করতো। তাদের সম্মিলিত প্রোজেক্ট শুধু ক্লাসেই সেরা হলো না, জেলা বিজ্ঞান মেলাতেও প্রথম স্থান অধিকার করলো, যা তাদের দুজনের জন্য ছিল এক বিরাট সাফল্য, এবং তাদের সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলো। তাদের মধ্যে এক নতুন বোঝাপড়া তৈরি হলো, এক অদৃশ্য সম্পর্ক গড়ে উঠলো।
সেই শুরু। এরপর থেকে তারা প্রায়ই একসাথে লাইব্রেরিতে বসতো, কঠিন অঙ্ক কষতো, বা ক্লাসের আলোচনায় অংশ নিতো। দিশা আকাশকে তার হাতে লেখা সুন্দর নোট দিতো, পরিষ্কার অক্ষরে লেখা সেই নোটগুলো আকাশের কাছে ছিল এক অমূল্য সম্পদ, যা সে যত্ন করে রাখতো, বইয়ের মাঝে লুকিয়ে রাখতো। কোনো বিষয় বুঝতে অসুবিধা হলে তাকে সহজ করে বোঝাতো, ধৈর্য ধরে তার সব প্রশ্নের উত্তর দিতো, কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতো না, যেন আকাশের প্রশ্ন তার কাছে আনন্দের বিষয় ছিল। আকাশও দিশাকে তার নিজের মতো করে সহজবোধ্য করে ব্যাখ্যা দিতো, বিশেষ করে গণিত ও বিজ্ঞানের জটিল সমস্যাগুলো সে এমনভাবে বুঝিয়ে দিতো যা দিশার কাছে অনেক সহজ মনে হতো। তাদের বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগলো। দিশা আকাশের মধ্যে কেবল একজন মেধাবী ছাত্রকেই দেখতে পেতো, তার দারিদ্র্যকে নয়। সে আকাশের ভেতরের মানুষটাকে দেখতো, তার স্বপ্নের বিশালতাকে বুঝতো, তার সততাকে চিনতে পারতো। আকাশের কাছে দিশা ছিল এক স্নিগ্ধ, পবিত্র উপস্থিতি, যে তার জীবনের সব হতাশা, সব ক্লান্তি দূর করে দিতো। দিশার উপস্থিতি আকাশের জীবনে এক নতুন আশার আলো নিয়ে এসেছিল, যেন এক মরুভূমির মাঝে হঠাৎ করে এক মরুদ্যান পাওয়া, যা তার পিপাসা মেটাতো, তার মনকে সতেজ রাখতো।
একদিন, স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একটি নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। দিশা সেই নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছিল। স্কুলের বিশাল অডিটোরিয়াম দর্শকে ভরে উঠেছিল, প্রতিটি আসন ছিল পূর্ণ, যেন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না, প্রতিটি মুখ ছিল উজ্জ্বল। আকাশের কাছে টিকেট কেনার পয়সা ছিল না। সে মনমরা হয়ে স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, ভেতরের কোলাহল আর হাসির শব্দ শুনে তার মন আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, তার চোখে জল আসছিল। সে জানতো, তার পক্ষে এই ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়, সে যেন এক কাঁচের দেয়াল দিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, সমাজের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ দিশা তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো। তার চোখে ছিল এক ঝলমলে হাসি, যা আকাশের মুখেও হাসি এনেছিল, যেন সেই হাসিতে সব দুঃখ দূর হয়ে গিয়েছিল।“আকাশ, তুই এখানে? ভেতরে আয় না! নাটক শুরু হতে যাচ্ছে।” দিশা হাসিমুখে বললো, তার গলায় ছিল এক আন্তরিক আহ্বান, যা আকাশকে মুগ্ধ করলো, তার মনে এক অদ্ভুত শান্তি নিয়ে এলো।আকাশ মাথা নিচু করে ইতস্তত করে বললো, “না, আমি… আমার আসলে টিকেট নেই।” তার গলায় লজ্জা আর হতাশা স্পষ্ট, যেন সে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেললো, যা সে কখনো করতে চায়নি।দিশা একটু অবাক হলো, কিন্তু পরক্ষণেই তার মুখে হাসি ফুটলো। সে আকাশের হাত ধরলো, তার হাতে এক কোমল স্পর্শ। “আরে বোকা! বন্ধুত্বের জন্য টিকেট লাগে নাকি? চল, আমার সাথে। ভেতরে অনেক জায়গা আছে।”সে আকাশের হাত ধরে জোর করে ভেতরে নিয়ে গেল। সেদিন দিশা আকাশের হাত ধরেছিল, যা আকাশের জীবনে নতুন এক অনাবিল অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল। সেই স্পর্শ ছিল এক বন্ধুত্বের উষ্ণতা, এক অদৃশ্য বাঁধন যা তাদের দুজনকে আরও কাছাকাছি এনেছিল, তাদের হৃদয়কে এক করে দিয়েছিল। আকাশ সেদিন দিশার পাশে বসে নাটক দেখেছিল, আর তার মনে হয়েছিল, তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নটা যেন সেদিনই সত্যি হয়ে গিয়েছিল, যেন সে স্বর্গীয় আনন্দে ভাসছিল। দিশার উপস্থিতিতে যেন তার সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে গিয়েছিল, তার মন আনন্দে ভরে উঠেছিল, তার জীবন এক নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছিল।
ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্ব ভালোবাসার দিকে মোড় নিতে শুরু করলো। তারা একে অপরের প্রতি এক গভীর, অব্যক্ত আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলো। তাদের চোখের ভাষা যেন সব কথা বলে দিত, তাদের মৃদু হাসি একে অপরের প্রতি ভালোবাসার নীরব ঘোষণা ছিল। তবে তাদের কেউই সরাসরি সেই ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতো না, তাদের মধ্যে এক নীরব চুক্তি ছিল। তাদের নীরব চোখের ভাষা, ছোট ছোট ইশারা, একে অপরের প্রতি যত্নশীল মনোভাব আর মৃদু হাসি – এই সবকিছুতেই সেই ভালোবাসার প্রকাশ পেতো। তারা একে অপরের উপস্থিতি ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ মনে করতো, তাদের দিন যেন শুরুই হতো না। তারা একে অপরের চিন্তায় ডুবে থাকতো, ক্লাসে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাদের মন চলে যেত একে অপরের কাছে। যখন তারা একে অপরের দিকে তাকাতো, সময় যেন থমকে যেত, যেন পৃথিবীটা শুধু তাদের দুজনের জন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
একদিন স্কুলের ছুটি হয়ে গেছে। আকাশ ভেঙে যাওয়া ছাতা নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটছিল। আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল, যেন এখনই ঝড় নামবে, প্রকৃতিও যেন তাদের দুঃখের পূর্বাভাস দিচ্ছিল। হঠাৎই তুমুল বৃষ্টি নামলো, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছিল যেন। দিশার ড্রাইভার তখনও আসেনি। দিশা একটি ছাউনির নীচে দাঁড়িয়েছিল, তার মুখে চিন্তার ছাপ, তার চুল ভিজে যাচ্ছিল। আকাশ তার পুরোনো ছাতাটা বের করে বললো, “চলো দিশা, আমি তোমাকে বাসস্টপ পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছি।” তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক আন্তরিকতা, এক গভীর অনুভূতি, যা দিশার মনেও এক নতুন সাড়া জাগিয়েছিল, এক উষ্ণতা নিয়ে এসেছিল।দিশা হাসিমুখে রাজি হলো। ছাতার নীচে দুজন পাশাপাশি হাঁটছিল, একে অপরের স্পর্শে এক অব্যক্ত আনন্দ অনুভব করছিল। তাদের কাঁধে কাঁধ লেগেছিল, যা তাদের হৃদয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল, এক অদ্ভুত শিহরণ, যা আগে কখনো অনুভব করেনি। গন্তব্য তাদের দুজনেরই এক নয়, কিন্তু সেই মুহূর্তে তাদের পথ যেন এক হয়ে গিয়েছিল, তাদের হৃদয় এক পথে চলতে শুরু করেছিল। তাদের চারপাশে বৃষ্টির শব্দ ছিল, গাড়ির হর্ন বাজছিল, মানুষের কোলাহল ছিল, কিন্তু তাদের মনের ভেতরে যেন এক নীরব সংগীত বাজছিল, এক প্রেমের সুর, যা শুধু তারা দুজনই শুনতে পাচ্ছিল। যখন তারা বাসস্টপে পৌঁছালো, দিশার ড্রাইভারের গাড়ি চলে এসেছিল। দিশা গাড়িতে ওঠার আগে আকাশের দিকে ফিরে তাকালো।“আকাশ, তোমার ছাতাটা আমার কাছেই থাক। কালকে দেব।” দিশা হাসিমুখে বললো, তার চোখে ছিল এক মিষ্টি হাসি, এক নীরব প্রতিশ্রুতি।আকাশ কিছু বলার আগেই দিশা গাড়িতে উঠে পড়লো, কিন্তু তার চোখে ছিল এক মিষ্টি হাসি আর এক অদৃশ্য বার্তা – যেন সে আকাশের মনে এক নতুন আশা জাগিয়েছিল, এক নীরব প্রতিজ্ঞা। পরদিন দিশা যখন ছাতাটা ফেরত দিল, আকাশ দেখলো ছাতাটা মেরামত করা হয়েছে, তার হাতলটাও নতুন করে লাগানো হয়েছে, যেন কেউ যত্ন করে এটি ঠিক করেছে, এটি তার ভালোবাসার প্রমাণ ছিল। আর তার হাতে একটা নতুন বই তুলে দিল – পাওলো কোয়েলহোর “দ্য আলকেমিস্ট”। দিশা হাসিমুখে বললো, “তোমার প্রিয় লেখকের বই। এটা আমার উপহার। জানি, তুমি পড়তে ভালোবাসো, আর এই বইটা তোমার খুব ভালো লাগবে।”আকাশের চোখ ছলছল করে উঠলো। সে বুঝতে পারছিল, দিশা তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হয়ে উঠছে। তার হৃদয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো, যেখানে দিশার উপস্থিতি এক অন্যরকম অর্থ নিয়ে এসেছিল – এক সত্যিকারের ভালোবাসার অর্থ, যা তাকে নতুন করে বাঁচতে শেখাচ্ছিল, যা তার জীবনে এক নতুন রঙ এনে দিয়েছিল।
কয়েক মাস পর, নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হলো। দশম শ্রেণীর প্রথম দিনেই তাদের ক্লাসে এলো এক নতুন ছাত্রী, সুরভি। সে ছিল স্মার্ট, আত্মবিশ্বাসী এবং অত্যন্ত সুন্দরী। তার উজ্জ্বল মুখ, আধুনিক পোশাক, এবং হাসিখুশি ব্যক্তিত্ব সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সুরভি মেধাবীও ছিল, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও গণিতে তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো। খুব দ্রুত সে ক্লাসের সকলের সাথে মিশে গেল, তার চারপাশে বন্ধুদের ভিড় লেগেই থাকতো, যেন সে ক্লাসের নতুন মধ্যমণি।
একদিন, রসায়নের ক্লাসে একটি জটিল সমস্যার সমাধান নিয়ে শিক্ষক আলোচনা করছিলেন। ক্লাসের কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারছিল না, এমনকি দিশাও কিছুটা দ্বিধায় ছিল। ঠিক তখনই আকাশ উঠে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার ও নির্ভুলভাবে সমস্যাটির সমাধান করে দিল। তার ব্যাখ্যা শুনে শিক্ষক মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং ক্লাসের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। সুরভি আকাশের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। তার চোখে ছিল এক গভীর মুগ্ধতা, যা এর আগে সে কোনো ছেলের প্রতি অনুভব করেনি। ক্লাস শেষে সুরভি সরাসরি আকাশের কাছে গিয়ে বললো, “আকাশ, তুমি অসাধারণ! তোমার মতো এত বুদ্ধিমান ছেলে আমি আর দেখিনি। তুমি কি আমাকে এই সমস্যাটা একটু বুঝিয়ে দেবে?” আকাশ প্রথমে একটু ইতস্তত করলো, কারণ দিশা সবসময় তার পাশে থাকতো এবং তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য বোঝাপড়া ছিল। কিন্তু সুরভির আন্তরিক অনুরোধ সে উপেক্ষা করতে পারলো না।
পরের কয়েকদিন, সুরভি প্রায়শই আকাশের সাথে লাইব্রেরিতে এসে বসতো। সে আকাশের নোট দেখতো, তার সাথে গণিত ও বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতো। সুরভির আগ্রহ দেখে আকাশও তাকে সাহায্য করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করলো। দিশা দূর থেকে তাদের দেখতো। সুরভি যখন আকাশের দিকে ঝুঁকে কথা বলতো বা হাসিমুখে তার কাঁধে হাত রাখতো, দিশার মনে এক অদ্ভুত অস্বস্তি হতো। সে নিজেকে বোঝাতো, আকাশ শুধু তার বন্ধু, কিন্তু তার ভেতরে এক সূক্ষ্ম ঈর্ষা জন্ম নিচ্ছিল। সে জানতো, আকাশ তার জীবনে কতটা মূল্যবান, আর তাকে হারানোর ভয় তার মনে এক অজানা কষ্টের সৃষ্টি করছিল। এক সন্ধ্যায়, লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে দিশা আকাশকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো, “সুরভি কি তোমার খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে, আকাশ?” আকাশের মুখে মৃদু হাসি, “হ্যাঁ, সে খুব ভালো মেয়ে। আর মেধাবীও বটে।” দিশা চুপ করে গেল। তার মনে হলো, আকাশ তার ভেতরের কষ্টটা বুঝতে পারছে না, অথবা সে নিজেও জানে না তার মনে কী চলছে।
তবে, এই নতুন পরিস্থিতি আকাশ আর দিশার মধ্যে এক নতুন বোঝাপড়া তৈরি করলো। দিশা বুঝতে পারলো, আকাশের প্রতি তার অনুভূতি শুধুমাত্র বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটা গভীর ভালোবাসা। অন্যদিকে, আকাশও সুরভির সাথে সময় কাটাতে গিয়ে উপলব্ধি করলো যে, দিশার নীরব উপস্থিতিই তার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তার হাসি, তার স্পর্শ – সব কিছুই তার কাছে অন্যরকম অর্থ বহন করে। সুরভির আগমনে তাদের মধ্যে যে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল, তা আসলে তাদের একে অপরের প্রতি টানকে আরও স্পষ্ট করে তুললো। তাদের সম্পর্ক যেন এক অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলো। তারা বুঝতে পারছিল, তাদের সম্পর্ককে বাঁচাতে হলে তাদের দু’জনকেই কঠিন সংগ্রাম করতে হবে, এক কঠিন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে।
দিশার বাবা-মা অবশ্য আকাশের সাথে তাদের মেয়ের এই ঘনিষ্ঠতা ভালো চোখে দেখছিলেন না। তারা সমাজের উঁচু পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং নিজেদের মেয়ের জন্য একজন উচ্চবিত্ত, প্রতিষ্ঠিত পরিবারের পাত্র খুঁজছিলেন, যা তাদের সামাজিক মর্যাদার সাথে মানানসই হবে, যা তাদের মান-সম্মান বাড়াবে। আকাশের আর্থিক অবস্থা তাদের কাছে এক বিরাট বাধা ছিল, যেন এক দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর। তারা লক্ষ করছিলেন, দিশা ইদানীং আকাশের সাথে বেশি সময় কাটাচ্ছে, তার পড়াশোনার বাইরেও যেন এক অন্যরকম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে, যা তাদের সমাজের জন্য মানানসই নয়, যা তাদের মান-সম্মান নষ্ট করবে, তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যে আঘাত হানবে। মাঝে মাঝেই দিশাকে তারা আকাশের থেকে দূরে থাকতে বলতেন, তাকে বোঝাতেন যে তাদের সামাজিক স্তরে আকাশ মানানসই নয়, এবং এই সম্পর্ক তাদের পরিবারের মান-সম্মান নষ্ট করবে। তারা আকাশের দারিদ্র্যকে একরকম উপহাস করতো, তাকে ছোট করে দেখতো, যেন সে কোনো মানুষই নয়। কিন্তু দিশা ছিল সরল মনের। সে আকাশের দারিদ্র্যকে গুরুত্ব দিত না, সে দেখতো আকাশের ভেতরের মানুষটাকে, তার মেধা, তার স্বপ্ন আর তার সততাকে। তার কাছে আকাশের সামাজিক অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ গৌণ, তার কাছে আসল ছিল আকাশের বিশুদ্ধ মন আর তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, তার মূল্যবোধ।
চলবে…..
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion