Episode 41033 words0 views

অদৃশ্য বাঁধন : চতুর্থ অধ্যায়

পারিবারিক বাধা ও বিভেদের সূত্রপাত দিশার বাবা-মা প্রথমে নরমভাবে বুঝিয়েছিলেন, তারপর কঠোর হয়েছিলেন। তাদের কথায় যেন লোহার মতো দৃঢ়তা ছিল, যা ভাঙার সাধ্য দিশার ছিল না। তারা দিশাকে আকাশ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিলেন, তার ভবিষ্যতের কথা বলে তাকে ভয় দেখাতে চাইলেন – তার উচ্চশিক্ষা, তার সামাজিক মর্যাদা, তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ – সবকিছুর দোহাই দিলেন, যেন আকাশ তার সব স্বপ্ন ভেঙে দেবে। দিশার উপর নজরদারি বাড়ানো হলো। তার মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় সীমিত করা হলো, তাকে প্রায় গৃহবন্দী করে রাখলেন, তাকে ঘরের বাইরে বের হতে দিতেন না, এমনকি তার নিজের ঘরেও তার গতিবিধি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হলো। তার জন্য নতুন ড্রাইভার দিলেন যে তাকে সরাসরি স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতো এবং ছুটির দিনেও তার উপর কড়া নজর রাখতো, যেন সে কোনো অপরাধী, কোনো জেল খাটা আসামি। এমনকি তার বন্ধুদের সাথে দেখা করাও নিষিদ্ধ করে দিলেন, বিশেষ করে যারা আকাশের বন্ধু ছিল বা আকাশের কাছাকাছি থাকতো। দিশার জীবন যেন এক সোনার খাঁচায় বন্দী হয়ে গেল, যেখানে তার কোনো স্বাধীনতা ছিল না, তার কোনো ইচ্ছার মূল্য ছিল না, তার শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হতো। প্রতিটি মুহূর্তে সে নিজেকে অসহায় মনে করতো, যেন তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। সে দিশাহীন হয়ে পড়েছিল, যেন গভীর সমুদ্রে এক ছোট নৌকা। একবার স্কুলের বার্ষিক স্পোর্টস ডে ছিল। বিশাল স্টেডিয়াম দর্শকে ভরে উঠেছিল, প্রতিটি আসন ছিল পূর্ণ, যেন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না, প্রতিটি মুখ ছিল উচ্ছ্বাসে ভরা। আকাশ ১০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হয়েছিল, যা ছিল তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর শারীরিক পরিশ্রমের ফল। সে যেন বাতাসের গতিতে ছুটেছিল, বাকিদের অনেক পেছনে ফেলে, জয় তার হাতের মুঠোয় ছিল, যা তার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল। দিশা স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিল, তার চোখে ছিল গর্বের ঝলক, যেন তার নিজেরই জয় হয়েছে, তার বুক ভরে গিয়েছিল আনন্দে। আকাশের পরিবারের কেউ আসেনি, কারণ তাদের কাছে এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার মতো সময় বা সুযোগ ছিল না। তারা তো শুধু তাদের দু’বেলার খাবারের সংস্থান করতেই ব্যস্ত, তাদের জীবনের সংগ্রামই ছিল সব। দিশা তার বাবা-মাকে জোর করে রাজি করালো আকাশকে অভিনন্দিত করার জন্য। দিশার বাবা-মা অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্টেজে গিয়ে আকাশের সাথে হাত মেলালেন, কিন্তু তাদের চোখে ছিল স্পষ্ট অনীহা আর বিরক্তি, যেন তারা কোনো নোংরা জিনিস স্পর্শ করছেন, তাদের মুখে ছিল এক চাপা ঘৃণা। আকাশের বাবা-মায়ের অনুপস্থিতি দিশার বাবা-মাকে আরও বেশি করে বিরক্ত করেছিল, যা তাদের কাছে আকাশের সামাজিক অবস্থানের এক চূড়ান্ত প্রমাণ ছিল। তারা যেন এই সুযোগে আকাশকে আরও ছোট করতে চাইছিলেন, তাকে সমাজের চোখে হেয় করতে চাইছিলেন, তার আত্মসম্মানকে আঘাত করতে চাইছিলেন। সেই রাতে দিশার বাড়িতে এক বিশাল পারিবারিক ঝগড়া হলো। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে গিয়েছিল তাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে। দিশার বাবা, একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, যার কথায় সবকিছু হতো, স্পষ্ট ভাষায় বললেন, “দিশা, তুমি আর ওই বস্তির ছেলের সাথে মিশবে না। ওর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। আমরা তোমাদের সম্পর্ককে মেনে নিতে পারবো না, এটা আমাদের পারিবারিক মর্যাদার প্রশ্ন। আমাদের সমাজের সম্মান আছে, আমাদের একটি ঐতিহ্য আছে।” তার গলায় ছিল দৃঢ়তা আর আদেশ, যা ভাঙার সাধ্য দিশার ছিল না, সে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।দিশা কাঁদতে কাঁদতে বললো, “বাবা, আকাশ খুব ভালো ছেলে। ও এত মেধাবী! ও একদিন অনেক বড় হবে। ওর মনটা কত পরিষ্কার, ওর মতো মানুষ হয় না, ওকে তুমি চেনো না।”“মেধা দিয়ে কী হবে? মেধা পেটে ভাত দেয় না! মেধা দিয়ে আমাদের সমাজে টিকে থাকা যায় না! আমাদের সমাজের নিয়ম আছে, দিশা। আমরা যে সমাজে থাকি, সেখানে মেধা নয়, বংশ আর প্রতিপত্তিই আসল। ও আমাদের যোগ্য নয়, তুমি ওকে ভুলে যাও,” তার মাও দৃঢ়ভাবে বললেন, তার চোখে ছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, যেন তিনি দিশার ভবিষ্যৎ লিখে দিচ্ছিলেন। তিনি যেন দিশাকে একরকম শাসালেন, তার ইচ্ছাকে দমন করতে চাইলেন, তার ভালোবাসাকে অস্বীকার করতে চাইলেন। দিশা বুঝতে পারছিল, তার বাবা-মা তার ভালোবাসাকে কোনোদিন মেনে নেবে না, তাদের সমাজের নিয়মই তাদের কাছে সব, ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই, কোনো মানবিকতা নেই। পরের দিন স্কুলে আকাশ দেখলো দিশা তাকে এড়িয়ে চলছে। তার মুখ মলিন, চোখ ফোলা, যেন সে সারারাত কেঁদেছে, তার চোখের নীচে কালি পড়েছিল। তার চোখে ছিল এক গভীর বিষাদ, যা আকাশকে বিদ্ধ করছিল। আকাশ বুঝতে পারছিল, কিছু একটা ঘটেছে, দিশা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। তার মনটা ছটফট করতে লাগলো, সে যেন অস্থির হয়ে উঠলো, তার হৃদয়ে এক গভীর যন্ত্রণা। সেদিন টিফিনের সময় আকাশ দিশাকে একান্তে ডেকে নিয়ে গেল স্কুলের নির্জন বাগানের এক কোণে, যেখানে তাদের কেউ দেখতে পাবে না, যেখানে শুধু গাছের পাতার শব্দ শোনা যেত, এক নীরব সাক্ষী।“দিশা, কী হয়েছে? তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছো কেন? তোমার চোখে জল কেন? আমাকে বলো, কী হয়েছে তোমার? আমার কী হয়েছে?” আকাশের কণ্ঠে ছিল উদ্বেগ, তার মনে ছিল এক অজানা ভয়, এক চাপা আশঙ্কা, যা তার বুক ভারী করে তুলেছিল।দিশা মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “আকাশ, আমার বাবা-মা চান না আমরা আর মিশি। তারা আমাকে তোমার থেকে দূরে রাখতে চান। তারা মনে করেন তুমি আমার জন্য খারাপ, তুমি আমার জীবন নষ্ট করবে, তুমি আমাকে ভুল পথে চালিত করছো।”আকাশের বুকটা ধক করে উঠলো। সে জানতো এমনটা হবে, কিন্তু এত দ্রুত হবে তা সে ভাবেনি। তার মনে হলো তার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে, পৃথিবীটা যেন তার চোখের সামনেই দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে, তার সব স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে, তার জীবনে এক গভীর অন্ধকার নেমে আসছিল।দিশা চোখের জল মুছতে মুছতে বললো, “ওঁরা আমাকে অন্য স্কুলে পাঠানোর কথা বলছেন, এমনকি বিদেশেও পাঠাতে পারেন। ওরা আমাকে তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে চায়, যাতে আমরা আর কোনোদিন দেখা করতে না পারি। ওরা আমাদের সম্পর্কটাকে শেষ করে দিতে চায়, আমাদের ভালোবাসাকে হত্যা করতে চায়।” তার গলায় ছিল চরম অসহায়তা, তার কণ্ঠস্বর প্রায় শোনা যাচ্ছিল না, যেন সে ফিসফিস করে কথা বলছিল।আকাশ স্তব্ধ হয়ে গেল। তার স্বপ্নভঙ্গের উপক্রম হলো, যেন তার সব স্বপ্ন এক নিমিষেই ভেঙে গেল। সে দিশার হাত ধরলো, তার হাত কাঁপছিল, তার চোখে ছিল এক গভীর প্রতিজ্ঞা, এক অদম্য সংকল্প, এক জীবনের শপথ। “দিশা, তুমি ভেবো না। আমি জানি, আমাদের রাস্তা কঠিন। কিন্তু আমি তোমাকে হারাতে দেব না। আমি যেকোনো মূল্যে তোমাকে ফিরিয়ে আনবো। আমি তোমাকে কোনোদিন ভুলবো না, আমি তোমার জন্য বাঁচবো, তোমার জন্য লড়বো।”দিশা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “আমিও তোমাকে হারাতে চাই না, আকাশ। আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। তুমিই আমার একমাত্র ভরসা, তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই, আমি একা হয়ে যাব।” সেই মুহূর্তে, তাদের নীরব ভালোবাসা যেন এক নতুন সংকল্পে পরিণত হলো। তারা একে অপরের হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করলো, যত বাধাই আসুক, যত দূরত্বই তৈরি হোক না কেন, তারা একে অপরের পাশে থাকবে। তাদের ভালোবাসা যেন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলো এই প্রতিকূলতার মুখে, যেন এক অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে তা আরও উজ্জ্বল হলো, এক ইস্পাতের মতো মজবুত বাঁধন তৈরি হলো, যা ভাঙা অসম্ভব। চলবে……  

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion