চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ও প্রতিজ্ঞার আগুন
দিশার বাবা-মা এবার আরও কঠোর হলেন। তারা দিশার মোবাইল ফোন সম্পূর্ণ কেড়ে নিলেন, তাকে গৃহবন্দী করে রাখলেন, যেন সে কোনো বন্দিনী। তাকে ঘরের বাইরে বের হতে দিতেন না, এমনকি তার নিজের ঘরেও তার গতিবিধি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হলো। তার জন্য নতুন ড্রাইভার দিলেন যে তাকে সরাসরি স্কুল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতো এবং ছুটির দিনেও তার উপর কড়া নজর রাখতো, যেন সে কোনো অপরাধী, কোনো ভয়ংকর শত্রু। এমনকি তার বন্ধুদের সাথে দেখা করাও নিষিদ্ধ করে দিলেন, বিশেষ করে যারা আকাশের বন্ধু ছিল বা আকাশের কাছাকাছি থাকতো। দিশার জীবন যেন এক সোনার খাঁচায় বন্দী হয়ে গেল, যেখানে তার কোনো স্বাধীনতা ছিল না, তার কোনো ইচ্ছার মূল্য ছিল না। প্রতিটি মুহূর্তে সে নিজেকে অসহায় মনে করতো, যেন তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি। সে দিশাহীন হয়ে পড়েছিল, যেন গভীর সমুদ্রে এক ছোট নৌকা।
একদিন, স্কুলের সামনে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো। দিশার বাবা একজন প্রভাবশালী স্থানীয় নেতাকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে এলেন। তার মুখ ছিল গম্ভীর, চোখে ছিল ক্রোধ, যেন তিনি কোনো যুদ্ধ জয় করতে এসেছেন, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল আত্মবিশ্বাসের সাথে। তিনি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেন, আকাশ দিশার পড়াশোনার ক্ষতি করছে, তার চরিত্র নষ্ট করছে এবং দিশাকে ভুল পথে চালিত করছে। তিনি এমনকি আকাশকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করার হুমকিও দিলেন, তার প্রভাব খাটিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে চাপ দিলেন, যাতে আকাশকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়, তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়া হয়, যাতে সে আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
স্কুলের অধ্যক্ষ একজন সৎ মানুষ ছিলেন। তিনি আকাশের মেধা সম্পর্কে জানতেন, তার পড়াশোনার প্রতি নিষ্ঠা সম্পর্কে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু দিশার বাবার প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বেশি ছিল। আকাশের পক্ষে কেউ ছিল না, তাকে সমর্থন করার মতো কোনো শক্তিশালী ব্যক্তি ছিল না, তার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। সেদিন ক্লাসে আকাশের সহপাঠীরাও তাকে টিটকারি মারতে শুরু করলো। আকাশের সহপাঠী, বিত্তবান পরিবারের ছেলে রনি, যে প্রথম থেকেই আকাশকে অপছন্দ করতো এবং তাকে সবসময় ছোট করার চেষ্টা করতো, সে বিদ্রুপ করে বললো, “বস্তির ছেলে হয়ে বড়লোকের মেয়ের পিছনে লেগেছে! দুঃসাহস তো কম নয়! নিজের যোগ্যতা ভুলে গেছে। ওকে তো এক্ষুনি স্কুল থেকে বের করে দেওয়া উচিত! ও তো আমাদের সমাজের যোগ্য নয়, ওকে কেন এই স্কুলে থাকতে দেওয়া হচ্ছে!” রনির কথায় বাকি ছেলেরাও হাসতে শুরু করলো, তাদের চোখে ছিল উপহাস, এক চূড়ান্ত ঘৃণা, এক সামাজিক বৈষম্য।
আকাশের চোখে জল এসে গিয়েছিল। সে সেদিন চরম অপমানিত বোধ করলো। তার মনে হচ্ছিল, এই অপমান তার সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে, এই দাগ কোনোদিনও মুছবে না। তার আত্মসম্মান যেন ধূলায় মিশে গিয়েছিল, তার অস্তিত্ব যেন অর্থহীন মনে হচ্ছিল। দিশা সেদিন স্কুলের সামনেই ছিল। সে সবকিছু শুনছিল, রনির কথাগুলো তার কানে বিষের মতো লাগছিল, তার রক্ত যেন ফুটতে শুরু করেছিল, তার সারা শরীর কাঁপছিল। রনির কথা শুনে সে এগিয়ে এসে রনির গালে সজোরে একটি চড় মারলো।“রনি! তোমার সাহস কী করে হয় এমন কথা বলার? আকাশ আমার বন্ধু, আর ওর মেধা তোমার মতো হাজারটা ছেলেকে পেছনে ফেলে দেবে! ওর যোগ্যতা নিয়ে কথা বলার সাহস তোমার নেই। তোমরা সবাই ওকে অপমান করছো, কিন্তু একদিন দেখবে ও কোথায় পৌঁছায়! ও তোমাদের সবার থেকে অনেক উপরে উঠবে!” দিশার গলায় ছিল তীব্র ঘৃণা, তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছিল, তার মুখে ছিল এক অদম্য সাহস।দিশার বাবা দিশাকে টেনে নিয়ে গেলেন। তিনি আকাশের দিকে ঘৃণার চোখে তাকালেন, তার চোখে ছিল চূড়ান্ত অবজ্ঞা, যেন আকাশ কোনো পোকামাকড়, কোনো অস্পৃশ্য। সেদিনই দিশাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তাকে জোর করে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো, যেন সে আকাশ থেকে চিরতরে দূরে চলে যায়, তাদের মধ্যে আর কোনোদিন দেখা না হয়। যেন তাদের প্রেমের গল্প এখানেই শেষ হয়ে যায়, এক অসমাপ্ত অধ্যায় হয়ে।
সেদিন ছিল তাদের শেষ দেখা। স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখলো, দিশাকে জোর করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। দিশা জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে আকাশের দিকে হাত নাড়লো, তার চোখে ছিল জল আর একরাশ শূন্যতা, এক অব্যক্ত কষ্ট। তার মুখ ছিল বেদনাভরা, তার সারা শরীর কাঁপছিল। আকাশও নির্বাক চোখে তাকে বিদায় জানালো, তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব আলো যেন নিভে গেছে, তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে, তার জীবনে যেন কোনো আশাই নেই। “আমি ফিরে আসবো, আকাশ! তোমার জন্য অপেক্ষা করবো!” দিশার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর যেন বাতাসের সাথে ভেসে এসে আকাশের কানে বাজছিল, সেই শব্দ তার মনে গেঁথে গিয়েছিল, তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছিল, তার বাঁচার একমাত্র কারণ।
আকাশের বুকে যেন হাজারো পেরেক পুঁতে দেওয়া হলো। তার ভালোবাসার মানুষটি তার কাছ থেকে দূরে চলে গেল। তার মনে হলো তার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, তার জীবনের সব রঙ যেন ফিকে হয়ে গেছে, তার সব আশা যেন ধুলোয় মিশে গেছে। সে সেদিন প্রতিজ্ঞা করলো। এই অপমান, এই দারিদ্র্য, এই দূরত্ব – কোনো কিছুই তাকে দুর্বল করতে পারবে না। সে প্রমাণ করবে, মেধা আর পরিশ্রমের কাছে কোনো সামাজিক উঁচু-নিচু বাধা নয়। সে দিশার যোগ্য হতে নিজেকে প্রমাণ করবে। তার একমাত্র লক্ষ্য হলো দিশাকে ফিরিয়ে আনা, এবং সমাজের চোখে নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা। সে জানতো, তাকে এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে হবে, তবে তা হবে মেধা আর যোগ্যতার মাধ্যমে, নিজের চেষ্টায়, এবং সততার পথে, কারো কাছে মাথা নত না করে।
চলবে……
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion