বিরহ, সংগ্রাম ও অদম্য অধ্যবসায়
দিশার চলে যাওয়ার পর আকাশের জীবন যেন আরও কঠিন হয়ে পড়লো। একদিকে ভালোবাসার বিরহ, যা তাকে প্রতি মুহূর্তে তীক্ষ্ণ শূলের মতো বিদ্ধ করছিল, তার হৃদয় যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, প্রতিটি নিঃশ্বাসে তার ব্যথা অনুভব হচ্ছিল। অন্যদিকে দারিদ্র্যের কশাঘাত, যা তার জীবনে এক কঠিন বাস্তবতা, এক নির্মম সত্য। দিশার স্মৃতি তাকে ঘুমোতে দিত না, খেতে দিত না, তার মন সবসময় দিশার চিন্তায় মগ্ন থাকতো, যেন দিশা তার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে মিশে গিয়েছিল। তার চারপাশের সবকিছু যেন অর্থহীন মনে হতে লাগলো, তার জীবনে যেন এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো, এক গভীর অন্ধকার। বস্তির জীবন তার কাছে আরও অসহনীয় মনে হতে লাগলো। দিনের পর দিন তাকে খালি পেটে থাকতে হতো, দুর্বল শরীরে পড়াশোনা করতে হতো, তার শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল অপুষ্টিতে। তার বাবা-মাও অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন বয়সের ভারে আর ক্রমাগত পরিশ্রমে। বাবার কাশি ক্রমশ বাড়ছিল, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, আর মায়ের হাত-পায়ে ব্যথা এমনভাবে বেড়ে গিয়েছিল যে তিনি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। তাদের চিকিৎসার জন্যেও অর্থের অভাব ছিল, যা আকাশের মনকে আরও বিচলিত করতো। প্রায়শই নকুড় দাস নামে সেই মহাজন লোক পাঠিয়ে তাদের হেনস্থা করতো, অবশিষ্ট জীর্ণ আসবাবপত্রগুলোও বিক্রি করে দেওয়ার হুমকি দিতো। এক রাতে, নকুড় দাস নিজে এসে আকাশের বাবার জামা টেনে ধরে প্রকাশ্যে শাসিয়ে গেল, “ঋণ শোধ কর, নয়তো তোর ছেলেকে বস্তিছাড়া করে দেব!” আকাশের বাবার চোখ ছলছল করে উঠেছিল, কিন্তু কিছুই বলার ছিল না। এই অপমান আকাশের মনে এক গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু দিশার প্রতিজ্ঞা, তার শেষ দেখা চোখ জল আর তার শেষ কথাগুলো – “আমি ফিরে আসবো, আকাশ! তোমার জন্য অপেক্ষা করবো!” – আকাশের মনে এক নতুন জেদ ঢুকিয়ে দিল। এই কথাগুলো তার মনে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো, যেন এক মন্ত্র তাকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দিচ্ছিল, তাকে আবার স্বপ্ন দেখতে শেখাচ্ছিল। সে প্রতিজ্ঞা করলো, সে একদিন বড় হবে, এতটাই বড় হবে যে কেউ তাকে বা তার ভালোবাসাকে অপমান করতে পারবে না, তার দিকে আঙুল তুলতে পারবে না। সে সিদ্ধান্ত নিল, তার জীবন দিয়ে সে প্রমাণ করবে যে মেধা আর পরিশ্রমের কাছে সমাজের কোনো বিভেদই টিকতে পারে না, কোনো প্রাচীরই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, কোনো সামাজিক নিয়মই তাকে আটকাতে পারবে না।
সেদিন থেকে আকাশ যেন এক অন্য মানুষ হয়ে গেল। তার জীবন থেকে হাসি, খেলার সময় সব উধাও হয়ে গিয়েছিল। তার মুখ থেকে হাসি যেন চিরতরে মুছে গিয়েছিল, তার চোখে শুধু সংকল্পের আগুন জ্বলছিল। সে দিনে-রাতে পড়াশোনা শুরু করলো, যেন প্রতিটি বইয়ের পাতা তার কাছে দিশার স্মৃতি, দিশার অস্তিত্ব, দিশাকে ফিরে পাওয়ার একমাত্র পথ। তার টেবিল ছিল পুরোনো বই আর কাগজের স্তূপ, যেখানে প্রতিটি পৃষ্ঠায় তার অধ্যবসায়ের ছাপ ছিল। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও সে জ্ঞান অর্জনের জন্য শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতো। তার কাছে বই ছিল একমাত্র বন্ধু, আর জ্ঞান ছিল একমাত্র সম্বল। লাইব্রেরির পুরোনো বইয়ের গন্ধে সে নিজেকে ডুবিয়ে দিতো, নতুন নতুন বিষয় শিখতো, বিশ্বের ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, আইন – সবকিছু সম্পর্কে জানার আগ্রহ তার তীব্র ছিল। সে যেন এক জ্ঞানপিপাসু ছাত্র, যার ক্ষুধা কখনো মেটতো না। রাতের বেলায় যখন পুরো বস্তি ঘুমিয়ে পড়তো, যখন চারপাশে শুধু কুকুরদের আওয়াজ শোনা যেত আর পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হতো, আকাশ তখনো রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোতে বসে পড়াশোনা করতো, তার চোখে ছিল এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, তার কপালে ছিল ঘাম। মা খাবার নিয়ে এলে সে খেতো, আর বাবা যখন ক্লান্ত হয়ে কাজ থেকে ফিরতেন, তখন তার চোখে দেখতেন এক নতুন স্বপ্ন – এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা, যা তার ছেলেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, যা তাদের দারিদ্র্যকে দূর করার একমাত্র উপায় ছিল, যা তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারতো।
চলবে……
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion