Episode 71115 words0 views

অদৃশ্য বাঁধন : সপ্তম অধ্যায়

সফলতার চূড়ায় আরোহন ও নতুন দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় আকাশ সারা রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করলো। তার নাম খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপা হলো। “বস্তির ছেলে রাজ্যে প্রথম!” – এই শিরোনামে তার সাফল্যের কথা ছড়িয়ে পড়লো, পুরো শহর জুড়ে তার নাম উচ্চারিত হলো। তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো, টেলিভিশনে তার গল্প বলা হলো, তাকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানানো হলো। তাকে নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলো, যেন সে এক নতুন নায়ক। বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে ভর্তি হওয়ার জন্য ডাক আসতে লাগলো, অনেকে তাকে সম্পূর্ণ স্কলারশিপের প্রস্তাবও দিল, তাকে বিনামূল্যে পড়ানোর প্রস্তাব দিল, তাকে সবরকম সাহায্য করার আশ্বাস দিল। কিন্তু আকাশের লক্ষ্য ছিল আরও বড়। সে জানতো, তাকে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা পাশ করতে হবে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে সে সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে বসতে পারবে – জেলা শাসক। যেখানে তার কোনো প্রভাবশালীর কাছে মাথা নত করতে হবে না, যেখানে সে তার নিজের মতো করে মানুষের জন্য কাজ করতে পারবে, সমাজের অন্যায় দূর করতে পারবে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, যেখানে সে তার নিজস্ব পরিচয় তৈরি করতে পারবে। এরপর সে ভর্তি হলো শহরের এক নামকরা সরকারি কলেজে, যেখানে তার মেধার স্বাক্ষর রেখে গেল। কলেজের লাইব্রেরি ছিল তার দ্বিতীয় বাড়ি। সে লাইব্রেরির প্রতিটি বই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তো, যেন বইগুলোই তার জীবন, তার পথপ্রদর্শক। বন্ধুদের কাছ থেকে বই ধার করে, টিউশনির সামান্য টাকা জমিয়ে সে পুরোনো বইপত্র কিনে পড়াশোনা চালিয়ে যেত। টিউশনির টাকা তার নিজের খরচ চালানোর জন্যও যথেষ্ট ছিল না, কিন্তু সে জানতো তাকে টিকে থাকতে হবে, এই সংগ্রাম তাকে জিততে হবে। অনেক রাত তাকে না খেয়ে ঘুমাতে হয়েছে, অনেক দিন তাকে ছেঁড়া পোশাকে কলেজে যেতে হয়েছে, যা দেখে সহপাঠীরা এখনো তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো, তাকে নিয়ে তামাশা করতো, তাকে এড়িয়ে চলতো। কিন্তু তার চোখ সবসময় লক্ষ্যে স্থির ছিল। তার স্বপ্ন ছিল দিশাকে ফিরিয়ে আনার, আর সমাজের জন্য কিছু করার। সে নিজেকে তৈরি করছিল এক কঠিন যুদ্ধের জন্য, যার শেষে তার স্বপ্ন পূরণ হবেই, যেখানে সে দিশাকে তার যোগ্য প্রমাণ করবে, যেখানে সে তার আত্মসম্মান ফিরে পাবে। কলেজ শেষ হতেই সে প্রস্তুতি শুরু করলো সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য। এই পরীক্ষা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, এক অগ্নিকুণ্ডের মতো। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতো, তাদের মধ্যে থেকে হাতে গোনা কয়েকজন নির্বাচিত হতো। প্রতিযোগিতা ছিল অত্যন্ত তীব্র, যেন এক মহাযুদ্ধ, যেখানে শুধু জয়ীরাই টিকে থাকে। আকাশ জানতো, তার পেছনে কোনো কোচিং সেন্টারের অর্থ নেই, কোনো বড় শিক্ষকের তত্ত্বাবধান নেই। তার একমাত্র পুঁজি তার মেধা, তার কঠোর পরিশ্রম আর দিশার জন্য ভালোবাসা। সে মনে মনে বলতো, “আমি হার মানবো না। দিশা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি তাকে হতাশ করতে পারবো না। এই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই হবে, আমি প্রমাণ করবো যে আমি কে।” প্রতিদিন ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠতো সে, যখন পুরো শহর ঘুমে আচ্ছন্ন, যখন শুধু কুকুরদের আওয়াজ শোনা যেত আর পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হতো। শহরের পার্কে গিয়ে কিছুক্ষণ দৌড়াতো, শরীরটাকে সতেজ রাখতো, মনটাকে শান্ত করতো, যেন নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করতো। তারপর এসে পড়াশোনা শুরু করতো, যেন প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান, প্রতিটি মুহূর্ত তার জীবনের জন্য অপরিহার্য। দিনে ১৫-১৬ ঘন্টা পড়াশোনা তার কাছে দৈনন্দিন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেন এটা তার একমাত্র কাজ, তার একমাত্র ধর্ম। যখনই তার মন ক্লান্ত হয়ে পড়তো, যখন ঘুম তার চোখে এসে জড়ো হতো, তার চোখের সামনে ভেসে উঠতো দিশার মুখ, তার শেষ বিদায়ের অশ্রুসিক্ত চোখ, আর সেই অপমানভরা দিনের স্মৃতি। এই স্মৃতিগুলোই তাকে নতুন করে শক্তি যোগাতো, তাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিতো। সে নিজেকে বলতো, “আমি যদি এখন হার মেনে নিই, তাহলে দিশার প্রতি আমার ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যাবে। আমি আর এই অপমান নিয়ে বাঁচতে পারবো না। আমাকে জিততেই হবে, আমাকে সফল হতেই হবে।” কয়েক বছরের নিরলস পরিশ্রমের পর অবশেষে সেই দিনটা এলো। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। আকাশ অনলাইনে ফলাফল দেখতে গিয়ে ভয়ে তার হাত কাঁপছিল, তার হৃদপিণ্ড যেন দ্রুত তালে বাজছিল, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, প্রতিটি অঙ্গ কাঁপছিল। তার নামটা দেখেই তার চোখে জল এসে গেল। সে প্রথম বারের চেষ্টাতেই সর্বভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম সারিতে স্থান পেল। শুধু তাই নয়, সে আই.এ.এস. (Indian Administrative Service) ক্যাডারে নির্বাচিত হলো। তার স্বপ্ন পূরণ হলো – সে একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা শাসক) হতে চলেছে। তার স্বপ্ন শুধু পূরণই হয়নি, সে যেন আকাশের তারাদের ছুঁয়ে ফেলেছিল, তার বহুদিনের স্বপ্ন সেদিন সত্যি হয়েছিল, তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য পূরণ হলো। তার মা-বাবার চোখ তখন আনন্দে ভরে গিয়েছিল, তাদের মুখে ছিল এক অনাবিল হাসি, তাদের স্বপ্ন সেদিন সার্থক হয়েছিল। প্রথমেই সে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের চোখে ছিল অশ্রুসিক্ত আনন্দ আর গর্ব, যেন তার বহুদিনের স্বপ্ন সেদিন সত্যি হয়েছে, তাদের সব দুঃখ দূর হয়ে গিয়েছিল। তার বাবা এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, তার মুখে ছিল এক নীরব হাসি, এক গভীর তৃপ্তি, যা আকাশের জন্য ছিল অমূল্য, তার জীবনের সেরা উপহার। বস্তির সবাই ছুটে এলো তাকে দেখতে, তাকে অভিনন্দন জানাতে। তাদের চোখে ছিল বিস্ময় আর শ্রদ্ধা, যেন তারা তাদের চোখে দেখা কোনো দেবতার আশীর্বাদ পেতে এসেছে, যেন আকাশ তাদের কাছে এক অনুপ্রেরণা। যে রনি একদিন তাকে অপমান করেছিল, সেও এসে করজোড়ে অভিনন্দন জানালো, তার মুখে ছিল স্পষ্ট অনুশোচনা, তার অহংকার ভেঙে গিয়েছিল, তার চোখ লজ্জায় নত ছিল। সমাজের সেই উঁচু-নিচু ভেদ যেন সেদিন মুছে গিয়েছিল। আকাশ বুঝতে পারলো, মেধা আর পরিশ্রমের কাছে কোনো প্রাচীর টেকে না, কোনো ভেদাভেদ টেকে না। মানুষ চাইলে সবকিছুই অর্জন করতে পারে, যদি তার অদম্য ইচ্ছা থাকে, আর কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে, তাহলে কিছুই অসম্ভব নয়। এরপর এলো ট্রেনিংয়ের পালা। কঠিন ট্রেনিং শেষে আকাশ তার প্রথম পোস্টিং পেল। তাকে রাজ্যের একটি প্রত্যন্ত জেলার জেলা শাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হলো। সেই জেলার মানুষ ছিল দরিদ্র, সুযোগ-সুবিধা ছিল সীমিত, দুর্নীতির সমস্যাও ছিল প্রবল। এখানে বিদ্যুৎ ছিল না, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব ছিল, আর মানুষের মৌলিক অধিকারও প্রায়শই লঙ্ঘিত হতো, তারা ছিল শোষিত। কিন্তু আকাশ তার কাজ মন দিয়ে শুরু করলো। সে সততা আর নিষ্ঠার সাথে তার দায়িত্ব পালন করতে লাগলো। সে জেলার সাধারণ মানুষের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প চালু করলো, তাদের সমস্যার সমাধান করলো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিশেষ গুরুত্ব দিল। কৃষকদের জন্য নতুন সেচ প্রকল্পের ব্যবস্থা করলো, বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করলো, মহিলাদের জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ব্যবস্থা করলো, তাদের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আকাশ সেই জেলায় একজন জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় জেলা শাসক হিসেবে পরিচিতি লাভ করলো। মানুষ তাকে ভালোবাসতো, বিশ্বাস করতো, তার কাছে তাদের সব সমস্যার সমাধান চাইতো, যেন তিনি তাদের ত্রাণকর্তা, তাদের একমাত্র আশা। নিজের কর্মজীবনে যতই সফল হোক না কেন, দিশার স্মৃতি তার মন থেকে কখনো মুছে যায়নি। তার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন দিশার স্মৃতি তাকে অনুসরণ করতো, তার প্রতিটি চিন্তায় দিশা ছিল। মাঝে মাঝে সে ভাবতো, দিশা এখন কোথায়? কেমন আছে? সে কি তার কথা মনে রেখেছে? নাকি তাকে ভুলে গিয়ে নতুন জীবনে এগিয়ে গেছে? এই প্রশ্নগুলো তাকে প্রায়ই ভাবাতো, তার মনকে অস্থির করে তুলতো, তাকে গভীর চিন্তায় ডুবিয়ে দিতো, তাকে কষ্ট দিতো। সে দিশার ঠিকানা জানতো না, যোগাযোগের কোনো মাধ্যমও ছিল না। তবুও তার মনের গভীরে এক ক্ষীণ আশা টিকে ছিল – একদিন তাদের আবার দেখা হবে, তাদের অসমাপ্ত প্রেমকাহিনী একদিন পূর্ণতা পাবে। সে প্রতিদিন অপেক্ষা করতো সেই দিনের জন্য, সেই অলৌকিক মুহূর্তের জন্য, যখন তারা আবার মুখোমুখি হবে, যখন তাদের প্রেম নতুন করে শুরু হবে। চলবে……  

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion