Episode 101360 words0 views

দশম অধ্যায় : বিস্মৃত পুঁথির সন্ধান

দৌড়! দিয়ার পৃথিবীতে এই একটা শব্দই তখন সত্যি ছিল। তার ফুসফুস ছিঁড়ে যাচ্ছিল, পায়ের পেশিতে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল, কিন্তু থামার কোনো উপায় ছিল না। তাদের পিছনে তাড়া করে আসছিল জমাট বাঁধা দুঃস্বপ্নের এক বাহিনী। ছায়াদের সম্মিলিত হিসহিস শব্দ আর মাটির উপর দিয়ে তাদের ধারালো নখের আঁচড়ের শব্দে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। “এদিকে!” কিংশুক চিৎকার করে তাকে একটা পাথুরে পথের দিকে টানল। একটা ছায়া, যার আকৃতি ছিল একটা বিশাল মাকড়সার মতো, তাদের সামনে লাফিয়ে পড়ল। সেটার আটটা চোখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিল শীতল, ঘৃণাভরা আলো। দিয়া ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিন্তু কিংশুক তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে একপাশে সরে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তার শরীরটা ঝিলিক দিয়ে উঠল এবং সে একটা বিশাল বুনো ষাঁড়ের রূপ নিল। তার শিং দুটো ছিল চাঁদের ফলার মতো বাঁকানো। সে মাথা নিচু করে সজোরে ছায়া-মাকড়সাটাকে ধাক্কা মারল। ছায়াটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ল, কিন্তু পরক্ষণেই আবার তার আকার ফিরে পেয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। “এভাবে ওদের বেশিক্ষণ আটকে রাখা যাবে না!” কিংশুক আবার নিজের রূপে ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। তার বহুরূপী ক্ষমতা ব্যবহারের ফলে সে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। তারা দৌড়াতে দৌড়াতে একটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। এখানকার গাছগুলো ছিল অদ্ভুত—তাদের কান্ডগুলো ছিল মসৃণ, সাদা পাথরের মতো আর পাতাগুলো ছিল কাঁচের মতো স্বচ্ছ। জঙ্গলের ভেতরে আলো-আঁধারির এক মায়াবী খেলা চলছিল। “এই জঙ্গলের নাম ‘ভুলভুলাইয়া বন’,” কিংশুক বলল। “এর ভেতরে ছায়ারা সহজে পথ খুঁজে পায় না।” তারা জঙ্গলের গভীরে একটা বিশাল, ফাঁপা গাছের কোটরের মধ্যে আশ্রয় নিল। বাইরে ছায়াদের হতাশ গর্জন আর এদিক-ওদিক ছোটাছুটির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর সব শান্ত হয়ে গেল। তারা আপাতত নিরাপদ। দিয়া মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল। তার সারা শরীর কাঁপছিল। অ্যাড্রেনালিনের ঘোরটা কেটে যেতেই ভয় আর ক্লান্তি তাকে চেপে ধরল। সে তার হাতের দিকে তাকাল। যে জায়গায় ছায়ার স্পর্শ লেগেছিল, সেখানকার চামড়া ফ্যাকাশে আর ঠান্ডা হয়ে গেছে, কোনো অনুভূতি নেই। “আমি কী করলাম, কিংশুক?” তার গলা দিয়ে কান্নার মতো স্বর বেরিয়ে এল। “আমি ভেবেছিলাম আমি একটা ভালো কাজ করেছি। কিন্তু আমার জন্য ছায়াপতি জেগে উঠল। আমার জন্য তুমি বিপদে পড়লে।” তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। “আমি… আমি রক্ষক হওয়ার যোগ্য নই।” কিংশুক তার পাশে বসল। সে নিজেও ক্লান্ত, কিন্তু তার চোখে ছিল গভীর সহানুভূতি। সে দিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুমি যা করেছ, তা গত পঞ্চাশ বছরে কেউ করার সাহস পায়নি, দিয়া। তুমি ‘বিষণ্ণ উপত্যকা’-য় আলো ফিরিয়ে এনেছ। ছায়াপতি ভয় পেয়েছে। সে জানে, তুমি যদি তোমার দিদিমার মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠো, তবে তার রাজত্ব শেষ হয়ে যাবে। তাই সে তোমাকে ভয় দেখিয়ে থামাতে চায়।” “কিন্তু আমি ভয় পেয়েছি,” দিয়া ফিসফিস করে বলল। “আমি খুব ভয় পেয়েছি।” “ভয় পাওয়াটা সাহসেরই একটা অংশ,” কিংশুক মৃদু হেসে বলল। “সাহস মানে ভয়হীন হওয়া নয়। সাহস মানে ভয় পাওয়া সত্ত্বেও এগিয়ে যাওয়া। আর তুমি ঠিক সেটাই করছ।” দিয়ার মনে হলো, কিংশুকের কথাগুলো যেন একটা মলমের মতো তার ক্ষতবিক্ষত আত্মবিশ্বাসের উপর প্রলেপ দিল। সে চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। “আমাদের শুধু পালিয়ে গেলে চলবে না। আমাদের জানতে হবে, ছায়াপতিকে হারানোর উপায় কী।” “কিন্তু কীভাবে জানব?” দিয়া প্রশ্ন করল। “বেঙ্গমা-ঠাকুর তো আমাদের শুধু প্রথম পরীক্ষার কথাই বলেছিলেন।” কিংশুক কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় ডুবে রইল। তারপর তার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। “একটা উপায় হয়তো আছে। কিন্তু সেটা খুব বিপজ্জনক।” সে বলতে শুরু করল, “আমাদের কল্পলোকে একটা জায়গা আছে, যার কথা এখনকার প্রজন্ম প্রায় ভুলেই গেছে। তার নাম ‘পুঁথি-পাঠাগার’। সেখানে বই বা পুঁথি নেই। সেখানে আছে… কথা। মানুষলোকে যত গল্প, যত ছড়া, যত ধাঁধা, যত গান তৈরি হয়েছে, তাদের প্রতিটা শব্দ বাতাসের ফিসফিসানির মতো সেখানে জমা হয়ে থাকে। সব জ্ঞান সেখানে জীবন্ত।” দিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। “এমন জায়গাও আছে?” “হ্যাঁ। কিন্তু সেখানে পৌঁছানো খুব কঠিন। আর তার চেয়েও কঠিন সেখান থেকে সঠিক জ্ঞান খুঁজে বের করা। পাঠাগারের রক্ষকরা হলো ‘শব্দ-রাক্ষস’। তারা ভুল প্রশ্ন করলে বা জ্ঞানের অসম্মান করলে প্রশ্নকর্তার জিহ্বা কেড়ে নেয়,” কিংশুক எச்சரிக்கை করল। “আমাদের সেখানেই যেতে হবে,” দিয়া दृढ़ গলায় বলল। “ছায়াপতিও তো একটা ভুলে যাওয়া গল্প। নিশ্চয়ই তাকে হারানোর উপায়ও কোনো পুরনো গল্পের মধ্যে লুকিয়ে আছে।” কিন্তু পথ? তারা তো পথ চেনে না। দিয়া হতাশ হয়ে তার দিদিমার খাতাটা আবার খুলল। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তার হঠাৎ মনে হলো, সে খাতাটার ভেতরের পাতাগুলোই শুধু দেখেছে, এর মলাটটা ভালো করে দেখেনি। সে চামড়ার মলাটের ভেতরের দিকে হাত বোলাল। একটা জায়গায় তার আঙুলে কাপড়ের মতো কিছু একটা ঠেকল। সে সাবধানে চামড়ার আস্তরণটা সরাতেই দেখল, তার নিচে একটা রেশমি কাপড়ের টুকরোয় সুতো দিয়ে একটা মানচিত্র সেলাই করা আছে। কিন্তু মানচিত্রটা অসম্পূর্ণ। কয়েকটা রেখা আর প্রতীক ছাড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। “এটা কীসের মানচিত্র?” কিংশুক ঝুঁকে পড়ে দেখল। দিয়ার হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ল। সে তার ঝোলা থেকে সাবধানে সেই ‘আনন্দ মঞ্জরী’ ফুলটা বের করল, যেটা সে উপত্যকা থেকে তুলে এনেছিল। সে ফুলটা মানচিত্রের উপর ধরল। ফুলের নীল আলোটা মানচিত্রের উপর পড়তেই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। সুতোর খালি জায়গাগুলোতে আলোর রেখা ফুটে উঠে মানচিত্রটাকে সম্পূর্ণ করে দিল। আর মানচিত্রের ঠিক মাঝখানে ফুটে উঠল একটা প্রতীক—একটা খোলা বইয়ের ছবি, যার পাতা থেকে বেরিয়ে আসছে স্বরবর্ণ। “পুঁথি-পাঠাগার!” তারা দুজন একসাথে বলে উঠল। “তোমার দিদিমা সব জানতেন,” কিংশুক মুগ্ধ হয়ে বলল। “তিনি তোমার জন্য পথ তৈরি করে রেখে গেছেন।” দিয়ার মনটা শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায় ভরে উঠল। তার দিদিমা শুধু একজন রক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী। দিয়া মানচিত্রটা ভালো করে দেখল। পাঠাগারে পৌঁছানোর জন্য তাদের একটা নদী পার হতে হবে, যার নাম ‘ধাঁধার সাগর’। মানচিত্র অনুসরণ করে তারা ‘ভুলভুলাইয়া বন’ থেকে বেরিয়ে এল এবং দীর্ঘ পথ হেঁটে পৌঁছাল এক বিশাল নদীর ধারে। নদীর জল ছিল আয়নার মতো স্থির আর তার রঙ ছিল কালির মতো কালো। সেই জলে আকাশ বা পাড়ের কোনো প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছিল না। নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল একটা পাতলা কুয়াশার আস্তরণ। নদীর ঘাটে বাঁধা ছিল একটাই নৌকা। আর সেই নৌকায় বসে হুক্কা টানছিল এক विचित्र মূর্তি। তার শরীরটা মানুষের মতো, কিন্তু মাথাটা একটা কঙ্কালের। তার পরনে মাঝিদের মতো পোশাক। “ইনিই ‘ধাঁধার মাঝি’,” কিংশুক ফিসফিস করল। “এনাকে নদী পার করার পারিশ্রমিক হিসেবে তিনটে ধাঁধার সঠিক উত্তর দিতে হয়। একটা ভুল হলেই সে নৌকাসুদ্ধু যাত্রীকে নদীর অতলে ডুবিয়ে দেয়।” তারা সাবধানে মাঝির কাছে গেল। মাঝি তাদের দিকে তার কঙ্কালের মাথাটা ঘোরাল। তার চোখের কোটরে দুটো সবুজ আগুন জ্বলছিল। সে তার ভাঙা, ঘর্ঘরে গলায় বলল, “নদী পার হবি? বেশ। আমার তিন প্রশ্নের উত্তর দে। প্রথম প্রশ্ন— ‘দিনে থাকে ঘুমিয়ে, রাতে ওঠে জেগে। আলো দেখলেই পালায় সে যে। বল তো সে কে?'” দিয়া আর কিংশুক একে অপরের দিকে তাকাল। এটা একটা সহজ ধাঁধা। কিংশুক হেসে উত্তর দিল, “অন্ধকার।” মাঝির কঙ্কালের মুখে হাসির মতো একটা ভঙ্গি ফুটে উঠল। “সঠিক। এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন—’বত্রিশ ভাই এক উঠোনে থাকে, মার খেলে সবাই কাঁদে। তারা কারা?'” এই ধাঁধাটাও দিয়ার চেনা। সে উত্তর দিল, “দাঁত আর জিভ।” “হুমম,” মাঝি তার হুক্কায় একটা লম্বা টান দিল। “তোরা তো বেশ চালাক। কিন্তু শেষ প্রশ্নটা সহজ হবে না।” সে তার সবুজ চোখের আগুন দিয়ে দিয়ার দিকে সরাসরি তাকাল। “আমার শেষ প্রশ্ন—’আমার কোনো গলা নেই, কিন্তু আমি কথা বলি। আমার কোনো শরীর নেই, কিন্তু আমি বেঁচে থাকি। আমি পুরনো হলে নতুন হই, কিন্তু আমি মরি না। আমি কে?'” এই ধাঁধাটা শুনে কিংশুক চিন্তায় পড়ে গেল। দিয়াও ভাবতে লাগল। গলা নেই কিন্তু কথা বলে, শরীর নেই কিন্তু বেঁচে থাকে… “গল্প!” হঠাৎ করে দিয়ার মাথায় উত্তরটা খেলে গেল। “এর উত্তর হলো গল্প! গল্পের কোনো শরীর বা গলা নেই, কিন্তু সে বেঁচে থাকে, কথা বলে। পুরনো গল্পই নতুন করে বলা হয়, তাই সে নতুন হয় কিন্তু কখনও মরে না।” মাঝির কঙ্কালের মুখে এবার সত্যিকারের বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল। সে মাথা নেড়ে বলল, “সঠিক। বহু কাল পর কেউ আমার তিনটে প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিল। আয়, নৌকায় ওঠ।” তারা নৌকায় উঠে বসল। নৌকাটা কোনো দাঁড় ছাড়াই নিজে থেকে চলতে শুরু করল। কালো জলের উপর দিয়ে চলার সময় দিয়ার মনে হলো, জলের নিচ থেকে যেন হাজার হাজার ফিসফিস শব্দ ভেসে আসছে। নদীর ওপারে পৌঁছে তারা দেখল, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল তোরণ, যা কোনো ইট বা পাথর দিয়ে তৈরি নয়। তোরণটা তৈরি হয়েছে লক্ষ লক্ষ ভাসমান অক্ষর দিয়ে, যা থেকে একটা মৃদু আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। “পুঁথি-পাঠাগার,” কিংশুক মুগ্ধ হয়ে বলল। তারা তোরণের ভেতরে পা রাখতেই একদল विचित्र প্রাণী তাদের পথ আটকে দাঁড়াল। তাদের শরীরটা ছিল কালির দলা দিয়ে তৈরি, আর তাদের হাত-পা ছিল কলমের নিবের মতো সূক্ষ্ম। তাদের চোখগুলো ছিল জ্বলন্ত full stop-এর মতো। “আমরা পুঁথি-পাঠাগারের রক্ষক, শব্দ-রাক্ষস,” তাদের মধ্যে একজন কর্কশ গলায় বলল। “কী চাস তোরা এখানে?” “আমরা ছায়াপতিকে হারানোর উপায় জানতে এসেছি,” দিয়া সাহস সঞ্চয় করে বলল। শব্দ-রাক্ষসটা হেসে উঠল। তার হাসির শব্দটা ছিল শুকনো পাতা ভাঙার মতো। “জ্ঞান এত সহজ নয়, মানুষলোকের মেয়ে। তোকে সঠিক প্রশ্ন করতে হবে। একটা ভুল শব্দ—আর তোর কথা বলার ক্ষমতা আমরা কেড়ে নেব।” দিয়া একটা গভীর শ্বাস নিল। সে বুঝতে পারল, তার আসল পরীক্ষাটা এবার শুরু হতে চলেছে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion