দিয়া আর কিংশুক পুঁথি-পাঠাগারের ভেতরে পা রাখল। তাদের চারপাশের জগৎটা বদলে গেল। এটা কোনো সাধারণ পাঠাগার নয়। এখানে কোনো বইয়ের তাক বা পুঁথির সারি নেই। তারা দাঁড়িয়েছিল এক অনন্ত, শূন্যস্থানের মাঝখানে, যেখানে লক্ষ লক্ষ অক্ষর, শব্দ আর বাক্য বাতাসের মধ্যে তারার মতো ভাসছিল আর মিলিয়ে যাচ্ছিল। কিছু শব্দ ছিল উজ্জ্বল, সোনালী—’ভালোবাসা’, ‘আশা’, ‘আনন্দ’। আবার কিছু শব্দ ছিল কালচে, বিবর্ণ—’যন্ত্রণা’, ‘বিচ্ছেদ’, ‘হতাশা’। তাদের মিলিত ফিসফিসানিতে বাতাসটা গুঞ্জরিত হচ্ছিল, যেন হাজার হাজার গল্প একসাথে তাদের কাহিনী শোনাতে চাইছে।
প্রধান শব্দ-রাক্ষসটা, যার শরীরটা ছিল একটা বিশাল কালির দলার মতো, তাদের সামনে এগিয়ে এল। তার জ্বলন্ত full stop-এর মতো চোখ দুটো দিয়ার মনের ভেতরটা পড়ার চেষ্টা করছিল। “জিজ্ঞেস কর, মানুষলোকের মেয়ে,” তার কর্কশ স্বর প্রতিধ্বনিত হলো। “কিন্তু মনে রাখিস, জ্ঞান হলো ধারালো তরবারির মতো। ভুল হাতে পড়লে তা নিজেকেই আঘাত করে।”
দিয়া এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। কী প্রশ্ন করবে সে? তার মাথায় প্রথম যে প্রশ্নটা এসেছিল, তা হলো—”ছায়াপতিকে হারানোর উপায় কী?” কিন্তু তার মন বলছিল, এই প্রশ্নটা ভুল। ছায়াপতিকে ‘হারানো’ বা ‘ধ্বংস’ করা হয়তো সঠিক পথ নয়। সে তো একসময় ‘মনন’ ছিল, একজন স্রষ্টা। তাকে ধ্বংস করার অর্থ হলো একটা গল্পকে চিরতরে মুছে দেওয়া। আর দিয়া নিজে একজন শিল্পী হয়ে আরেকজন শিল্পীর সৃষ্টিকে মুছে ফেলতে পারবে না।
সে বেঙ্গমা-ঠাকুরের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করল। “ভোলার যন্ত্রণায় সে পরিণত হলো ছায়াপতিতে।” যন্ত্রণা। এটাই হলো মূল সূত্র। ছায়াপতির শক্তি তার ঘৃণা থেকে আসে না, আসে তার যন্ত্রণা থেকে। আর যন্ত্রণার নিরাময় ধ্বংস নয়, আরোগ্য।
দিয়া সাহস সঞ্চয় করল। সে শব্দ-রাক্ষসের দিকে সরাসরি তাকিয়ে শান্ত কিন্তু दृढ़ গলায় তার প্রশ্নটা রাখল। সে জিজ্ঞেস করল না, “ছায়াপতিকে হারানোর উপায় কী?”
বরং সে জিজ্ঞেস করল, “যে গল্প ভুলে গেলে ‘মনন’ ছায়াপতি হয়ে যায়, সেই গল্পের শেষটা কী ছিল?”
তার প্রশ্নটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাঠাগারের সমস্ত গুঞ্জন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। ভাসমান অক্ষরগুলো স্থির হয়ে গেল। শব্দ-রাক্ষসদের জ্বলন্ত চোখগুলো বিস্ময়ে জ্বলে উঠল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল। এমন প্রশ্ন তারা বহুদিন শোনেনি। এ প্রশ্ন কোনো যোদ্ধার নয়, এ প্রশ্ন একজন গল্পকারের। এ প্রশ্ন ধ্বংসের নয়, সৃষ্টির।
প্রধান শব্দ-রাক্ষসটা তার মাথা নাড়ল। তার কর্কশ স্বরে এবার একটা সম্মানের সুর ছিল। “তুমি সঠিক প্রশ্ন করেছ, মালতীর নাতনি। তুমি জ্ঞানের মর্যাদা রাখতে জানো। এসো, আমরা তোমাকে সেই অসমাপ্ত কাহিনী দেখাই।”
শব্দ-রাক্ষসরা পথ ছেড়ে দিল। দিয়া আর কিংশুকের চারপাশের ভাসমান শব্দ আর অক্ষরগুলো এবার এক জায়গায় জড়ো হতে শুরু করল। তারা আর বিচ্ছিন্ন ছিল না, বরং সুতোর মতো একে অপরের সাথে জুড়ে গিয়ে ছবি তৈরি করতে লাগল। দিয়া দেখল, সে আর পাঠাগারে নেই, সে যেন একটা জীবন্ত গল্পের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে।
তার চোখের সামনে ফুটে উঠল এক তরুণের মুখ—মনন। তার চোখে ছিল সৃষ্টির আনন্দ আর অপার কৌতূহল। সে কল্পলোকের শিশুদের চারপাশে বসিয়ে গল্প শোনাচ্ছে। তার কথা থেকে জন্ম নিচ্ছে রঙিন প্রজাপতি, সুরের পাখি, কথা বলা গাছ।
তারপর দৃশ্য बदलল। তারা দেখল, মনন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে তৈরি করছে। সে তার সমস্ত ভালোবাসা, সমস্ত আশা দিয়ে তৈরি করছে এক আশ্চর্য পাখিকে। পাখিটার সারা শরীর ছিল হীরের মতো উজ্জ্বল, তার ডানা দুটো ছিল তরল সোনার মতো, আর তার চোখ দুটো ছিল নীলকান্ত মণির মতো নীল। মনন তার নাম দিয়েছিল ‘আলোর পাখি’।
গল্পের শব্দরা তাদের কানে কানে বলে চলল— “এই পাখির গান ছিল আশ্চর্য। তার গান শুনলে শুকনো গাছে ফুল ফুটত, বিষণ্ণ মুখে হাসি ফিরে আসত, আর অন্ধকারের গভীরেও আলো জ্বলে উঠত।”
কিন্তু তারপরের দৃশ্যগুলো ছিল যন্ত্রণার। তারা দেখল, মানুষলোকে মননের গল্পগুলো পুরনো হয়ে যাচ্ছে। তার লেখা বইগুলোয় ধুলো জমছে। আর তার প্রভাব পড়ছে কল্পলোকে। শিশুরা আর তার গল্প শুনতে চায় না, তারা নতুন, চটকদার কাহিনীর দিকে ঝুঁকছে। মনন একা হয়ে যাচ্ছে। তার সৃষ্টির আনন্দ ধীরে ধীরে হতাশায় পরিণত হচ্ছে।
আর তার মনের অন্ধকারের সাথে সাথে ‘আলোর পাখি’র উজ্জ্বলতাও কমে আসছিল। পাখিটার গান দুর্বল হয়ে পড়ছিল। একদিন, নিজের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, মনন তার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টিকে একটা অন্ধকার, কাঁটাওয়ালা খাঁচায় বন্দী করে দিল। সে আর আলোর গান শুনতে চাইত না, কারণ সেই আলো তার নিজের অন্ধকারকে আরও বেশি করে ফুটিয়ে তুলছিল।
দৃশ্যটা এখানেই থেমে গেল। পাঠাগারের শব্দগুলো আবার আগের মতো ভাসতে শুরু করল, কিন্তু এবার তাদের মধ্যে একটা গভীর বিষণ্ণতার সুর। কয়েকটা শব্দ দিয়ার সামনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াল, যেন একটা অসমাপ্ত কবিতার শেষ লাইন—
“…আর তাই আলোর পাখি অপেক্ষায় রইল তার ছায়ার খাঁচায়, এমন এক গানের জন্য যা কোনোদিন গাওয়া হবে না…”
প্রধান শব্দ-রাক্ষসটা এগিয়ে এল। “গল্পটা এখানেই অসমাপ্ত। একটা অসমাপ্ত গল্প হলো একটা না-শুকোনো ক্ষত। এটাই ছায়াপতির শক্তির উৎস, আর এটাই তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।”
দিয়ার কাছে এবার সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ছায়াপতিকে হারাতে হলে তাকে তলোয়ার চালাতে হবে না, তাকে আলপনার বর্ম তৈরি করতে হবে না। তাকে যা করতে হবে, তা হলো একজন গল্পকারের কাজ—একটা অসমাপ্ত গল্পকে সম্পূর্ণ করা। তাকে ‘আলোর পাখি’কে খুঁজে বের করে তাকে মুক্ত করতে হবে। সেই পাখির গানই পারবে মননের মনের অন্ধকার দূর করে তাকে আবার আগের রূপে ফিরিয়ে আনতে।
“কিন্তু সেই পাখি কোথায়?” কিংশুক জিজ্ঞেস করল।
“যেখানে স্রষ্টার যন্ত্রণা সবচেয়ে গভীর,” শব্দ-রাক্ষস উত্তর দিল। “ছায়াপতির দুর্গের একেবারে কেন্দ্রে, তার ‘হতাশার সিংহাসন’-এর পাশে সেই খাঁচা রাখা আছে।”
তাদের যাত্রা এবার স্পষ্ট। তাদের গন্তব্য—ছায়াপতির দুর্গ।
কিন্তু তারা পুঁথি-পাঠাগার থেকে বেরিয়ে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে, পাঠাগারের শব্দগুলো আবার একত্রিত হয়ে এক নতুন, ভয়ঙ্কর ছবি তৈরি করল।
এবার কল্পলোকের ছবি নয়। দিয়া দেখল তার নিজের শহর, কলকাতাকে। সে দেখল, শহরের পুরনো, পরিত্যক্ত জায়গাগুলো থেকে—একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া লাইব্রেরি, একটা ভেঙে পড়া পুরনো বাড়ি, একটা আবর্জনার স্তূপ—ধোঁয়ার মতো একটা ধূসর কুয়াশা বেরিয়ে আসছে। সেই কুয়াশা যেখানেই যাচ্ছে, সবকিছু থেকে রঙ শুষে নিচ্ছে। দিয়া দেখল, সেই কুয়াশা কয়েকজন পথচলতি মানুষকে স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুখ থেকে হাসি, আবেগ, সব অনুভূতি মুছে গেল। তারা যেন জীবন্ত পুতুলে পরিণত হলো, যান্ত্রিকভাবে হেঁটে চলেছে, তাদের চোখে কোনো প্রাণ নেই।
“এটা কী হচ্ছে?” দিয়া আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল।
“ছায়াপতি আর অপেক্ষা করছে না,” শব্দ-রাক্ষসের গলায় বিপদের সুর। “সে আলপনার দরজাগুলোকে বিকৃত করে দুই জগতের মধ্যে ছোট ছোট ফাটল তৈরি করেছে। সে তোমাদের জগৎ থেকেও প্রাণশক্তি শোষণ করতে শুরু করেছে। তোমাদের পৃথিবীর বিস্মৃতি আর হতাশা তার শক্তিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
দিয়ার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সে এতদিন ভাবছিল, সে কল্পলোককে বাঁচাতে লড়াই করছে। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারল, এই লড়াই শুধু কল্পলোকের নয়, এই লড়াই তার নিজের বাড়ির জন্যও। ছায়াপতির ছায়া তার নিজের শহরেও পড়তে শুরু করেছে।
তার মনে আর কোনো দ্বিধা রইল না। ভয় ছিল, কিন্তু ভয়ের চেয়েও বড় ছিল এক তীব্র দায়িত্ববোধ। সে কিংশুকের দিকে তাকাল। তার চোখে ছিল এক নতুন আগুন।
“আমাদের এখনই বেরোতে হবে,” সে বলল। “প্রতিটা মুহূর্ত দামী।”
এক নতুন সঙ্কল্প নিয়ে তারা পুঁথি-পাঠাগার থেকে বেরিয়ে এল। তাদের সামনে अब শুধু একটা লক্ষ্য—ছায়াপতির ‘দুঃস্বপ্নের দুর্গ’।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion