বিষণ্ণ উপত্যকায় ভোরের আলো ফুটল। সেই পটচিত্রের সূর্যটা যখন দিগন্তে উঁকি দিল, তার হলুদ মুখে ছিল এক নতুন ঔজ্জ্বল্য। তার আলোয় সারা উপত্যকা ঝলমল করে উঠল। যে মাটিটা গতকালও ছিল প্রাণহীন, স্পঞ্জের মতো, আজ তা উর্বর ঘাসের গালিচায় ঢাকা। মরা গাছের কঙ্কালগুলোতে গজিয়েছে কচি সবুজ পাতা, আর তাদের ডালে ডালে ফিরে এসেছে ছোট ছোট পাখিরা, তাদের কিচিরমিচির শব্দে উপত্যকার দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে যাচ্ছিল।
দিয়ার লাগানো সেই চারাগাছটা এর মধ্যেই অনেকটা বড় হয়ে গেছে, আর তার ডাল থেকে ফুটেছে প্রথম ‘আনন্দ মঞ্জরী’ ফুল—একটা উজ্জ্বল নীল রঙের ফুল, যার পাপড়িগুলো থেকে ভোরের আলোর মতো স্নিগ্ধ কণা ঝরে পড়ছে। ফুলটা থেকে একটা মিষ্টি, ভেজা মাটির মতো গন্ধ ভেসে আসছিল, যা দিয়ার সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে দিচ্ছিল।
“আমরা পেরেছি, কিংশুক!” দিয়া প্রায় শিশুর মতো আনন্দে হেসে উঠল।
কিংশুক ফুলটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। সে ঝুঁকে পড়ে আলতো করে একটা পাপড়ি ছুঁয়ে দেখল। “অনেক… অনেকদিন পর ‘আনন্দ মঞ্জরী’ ফুটল। তুমি পেরেছ, দিয়া। তুমি সত্যি মালতী-রক্ষকের নাতনি।” তার চোখে ছিল কৃতজ্ঞতার জল।
কিন্তু তাদের এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না।
হঠাৎ করেই পটচিত্রের সেই সুন্দর সূর্যটা ঢাকা পড়ে গেল। আকাশটা দিনের বেলাতেই ঘন, কালচে বেগুনি মেঘে ছেয়ে গেল, যেন কেউ একটা বিশাল কালিভরা তুলি আকাশে বুলিয়ে দিয়েছে। একটা তীব্র, কান-ফাটানো বজ্রপাতের মতো শব্দে সারা উপত্যকা কেঁপে উঠল, কিন্তু আকাশে কোনো বিদ্যুৎ চমকালো না। উপত্যকার বাতাসটা হঠাৎ করে বরফের মতো ঠান্ডা আর ভারী হয়ে গেল। পাখিদের কলরব ভয়ে থেমে গেল। ‘আনন্দ মঞ্জরী’ ফুলটা তার পাপড়িগুলো গুটিয়ে নিল, তার আলো ম্লান হয়ে গেল।
দিয়া দেখল, উপত্যকার অন্য প্রান্তে, পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় এক ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। তার অবয়ব আগের দেখা ছায়াদের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট। সে একটা লম্বা, কালো আলখাল্লা পরে আছে, যা দেখে মনে হচ্ছিল জমাট বাঁধা অন্ধকার বা লক্ষ লক্ষ মানুষের হতাশা দিয়ে বোনা। বাতাস তার আলখাল্লাকে ওড়াতে পারছিল না, সেটা তার চারপাশে স্থির ছিল। তার মুখটা ঢাকা একটা গভীর হুডের অন্ধকারে, যেখান থেকে দুটো জ্বলন্ত নীল চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সেই চোখ দুটো ছিল তারার মতো, কিন্তু তাতে কোনো আলো ছিল না, ছিল শুধু অনন্ত শূন্যতা আর শীতল ঘৃণা। তার উপস্থিতিতেই চারপাশের পাথরগুলো বরফে জমে যাচ্ছিল, ঘাসগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল।
“ছায়াপতি,” কিংশুক ফিসফিস করে বলল। তার মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। সে দিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল, তাকে আড়াল করার একটা মরিয়া চেষ্টায়।
ছায়াপতির গলার স্বর directamente তাদের মনের ভেতর বেজে উঠল, কোনো শব্দ ছাড়াই। তার কণ্ঠস্বর ছিল হাজার হাজার মানুষের কান্নার প্রতিধ্বনি। “মূর্খ মেয়ে। তুই ভাবলি, একটা ফুল ফুটিয়ে আমার রাজ্যকে তুই ধ্বংস করে দিবি? যে যন্ত্রণা আমার সৃষ্টিকে কেড়ে নিয়েছে, তার কাছে এই সামান্য আলো কিছুই নয়।”
তার কণ্ঠস্বর এবার আরও তীক্ষ্ণ, আরও ব্যক্তিগত হয়ে উঠল। “তোর দিদিমাও তোর মতোই বোকা ছিল। সেও ভেবেছিল, সাদা রেখা দিয়ে সে অন্ধকারকে বেঁধে রাখবে। কিন্তু দেখ, সে আজ কোথায়? আর আমি কোথায়? এটা তো শুধু শুরু। তোর জন্য এমন যন্ত্রণা অপেক্ষা করছে, যা তোর দিদিমাও কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি।”
ছায়াপতি তার হাতটা তুলল। তার আঙুলগুলো ছিল লম্বা আর সূক্ষ্ম, যেন শুকনো গাছের ডাল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের চারপাশের মাটি থেকে শয়ে শয়ে ছায়া উঠে আসতে লাগল। এবার তারা শুধু ধোঁয়ার মতো ছিল না, তাদের ধারালো নখ আর দাঁত দেখা যাচ্ছিল। তাদের আকৃতিগুলো ছিল ভুলে যাওয়া দুঃস্বপ্নের মতো—ডানাওয়ালা মাকড়সা, মাথাবিহীন ঘোড়া, শিশুদের কান্না দিয়ে তৈরি ছোট ছোট মূর্তি। তারা মাটি ফুঁড়ে ওঠার সময় সদ্য গজানো ঘাস আর ফুলগুলোকে পুড়িয়ে দিচ্ছিল।
“পালাও, দিয়া!” কিংশুক চিৎকার করে দিয়ার হাত ধরে টানল।
তারা দৌড়াতে শুরু করল। তাদের পিছনে তাড়া করে আসছিল ছায়াদের এক ভয়ঙ্কর বাহিনী। তাদের সম্মিলিত হিসহিস শব্দ আর মাটির উপর দিয়ে তাদের নখের আঁচড়ের শব্দে দিয়ার কান স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। একটা ছায়া তার খুব কাছ দিয়ে চলে গেল, আর তার শীতল স্পর্শে দিয়ার হাতের কিছুটা অংশ অবশ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল, তার প্রথম পরীক্ষায় সে পাশ করেছে ঠিকই, কিন্তু আসল যুদ্ধটা তো সবে শুরু হলো। আর এই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ শুধু শক্তিশালী নয়, সে তার সবচেয়ে বড় ভয় আর দুর্বলতাকে চেনে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion