গ্রামের আকাশ ঘন নীল মখমলের মতো, তাতে রুপোর থালার মতো চাঁদটা যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। উঠোনের শিউলি গাছ থেকে ভেসে আসছিল তীব্র, মাতাল করা গন্ধ। বাড়ির সবাই তখন দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু দিয়ার চোখে ঘুম ছিল না। তার হাতে দিদিমার সেই রহস্যময় খাতা। তার মন চঞ্চল।
সে পাতা ওল্টাচ্ছিল। একটার পর একটা নকশা, একটার চেয়ে আরেকটা বেশি জটিল ও রহস্যময়। একটা পাতায় এসে তার চোখ আটকে গেল। পাতাটার মাঝখানে আঁকা একটা বৃত্তাকার আলপনা। বৃত্তের কেন্দ্রে একটা অষ্টদল পদ্ম, আর তাকে ঘিরে সাতটা সর্পিল রেখা সাপের মতো একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে। নকশাটার পাশে তুলির টানে লেখা ছিল— ‘কল্পলোকের দ্বার’।
“কল্পলোকের দ্বার? কী সব যে লিখতেন দিদিমা,” দিয়া আপনমনে হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। শব্দটা তার মনের ভেতর বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
নকশাটা তাকে চুম্বকের মতো টানছিল। তার ভেতরের শিল্পীসত্তা জেগে উঠেছিল। এই ডিজাইনটার মধ্যে একটা অদ্ভুত গাণিতিক ভারসাম্য ছিল, একটা ছন্দ ছিল, যা সে তার ডিজিটাল আর্টেও খুঁজে বেড়ায়। এটা শুধু একটা ছবি নয়, এটা যেন একটা যন্ত্রের নকশা। একটা জেদ চেপে গেল তার মাথায়। সে ঠিক করল, এই আলপনাটা সে আঁকবে। দিদিমার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নয়, বরং নিজের শিল্পসত্তার একটা পরীক্ষা হিসেবে। সে দেখতে চেয়েছিল, সে কি পারে এই জটিল নকশাটাকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে?
ছোটবেলার আবছা স্মৃতি হাতড়ে সে রান্নাঘর থেকে একটা কাঁসার বাটিতে করে চালের গুঁড়ো নিয়ে এল। তাতে ধীরে ধীরে জল মিশিয়ে একটা পাতলা পেস্ট তৈরি করল। দিদিমা ঠিক এভাবেই করতেন, তার আবছা মনে পড়ছিল। দিয়া খাতাটা পাশে রেখে তার ঘরের ঠিক মাঝখানে, ঠান্ডা সিমেন্টের মেঝেতে আঁকতে বসল।
বাইরে চাঁদের আলো এসে পড়েছিল ঘরের ভেতর, একটা মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একটা অপার্থিব নিস্তব্ধতা চারদিকে, শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক শোনা যাচ্ছে। দিয়া প্রথমে খড়িমাটি দিয়ে নকশার আউটলাইনটা এঁকে নিল। তারপর আঙুলের ডগা চালের গুঁড়োর পেস্টে ডুবিয়ে সে রেখা টানতে শুরু করল।
প্রথমটায় তার হাত সামান্য কাঁপছিল। কিন্তু তারপরই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। তার আঙুলগুলো যেন নিজে থেকেই সঠিক পথে এগিয়ে চলল। শহরের মেয়ে দিয়া, যে কোনোদিন মাটি বা চালের গুঁড়ো নিয়ে কাজ করেনি, সে অবলীলায় এঁকে চলেছিল সেই জটিল নকশা। তার মনে হচ্ছিল, এই জ্ঞানটা তার নিজের নয়, এটা যেন তার রক্তে মিশে আছে, তার ডিএনএ-তে খোদাই করা আছে। এটা তার উত্তরাধিকার, যা এতদিন সুপ্ত ছিল।
ঘণ্টাখানেক পর আলপনাটা আঁকা শেষ হলো। ঘরের ঠিক মাঝখানে ফুটে উঠেছে এক আশ্চর্য সাদা নকশা। চাঁদের আলোয় সেটা যেন সামান্য নীলচে আভা নিয়ে জ্বলজ্বল করছে। দিয়া মুগ্ধ হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার সারা শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ। এই প্রথম তার মনে হলো, সে এই বাড়িটার সঙ্গে, তার শিকড়ের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছে।
সে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল।
আলপনার সাদা রেখাগুলো হঠাৎ করে উজ্জ্বল হতে শুরু করল। প্রথমে হালকা নীল, তারপর রুপোলি। দিয়ার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সে দেখল, রেখাগুলো আর মেঝের ওপর স্থির নেই। সেগুলো কাঁপতে কাঁপতে মেঝে থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে এসেছে, যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। চালের গুঁড়োর কণাগুলো আলোর বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
সর্পিল রেখাগুলো ঘুরতে শুরু করল, প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর তাদের গতি বাড়ল। একটা মৃদু, সুরেলা গুঞ্জন শব্দে ভরে গেল ঘরটা, যেন অনেকগুলো ঘুঙুর একসাথে বাজছে। দিয়া ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। আলপনাটা اب একটা ঘূর্ণির মতো দেখাচ্ছিল, একটা সাদা আলোর ঘূর্ণি। তার কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসছিল একটা নরম, উজ্জ্বল আলো, যা ঠান্ডা কিন্তু তীব্র।
তার চোখের সামনেই আলপনাটা একটা আস্ত দরজায় পরিণত হলো। একটা আলোর দরজা, যা বাতাসে ভাসছে। তার ওপারে কী আছে দেখা যাচ্ছিল না, শুধু অনন্ত আলোর আভাস আর রঙের খেলা।
দিয়ার হৃৎপিণ্ড গলার কাছে এসে ধুকপুক করছিল। এটা কী করে সম্ভব? এটা কি তার চোখের ভুল, নাকি সে তীব্র মানসিক চাপে হ্যালুসিনেশন দেখছে?
সে কাঁপা কাঁপা পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। ভেতর থেকে একটা ঠান্ডা হাওয়া আসছিল, সাথে একটা অচেনা মিষ্টি ফুলের গন্ধ, যা এই পৃথিবীর নয়। তার এক মন চিৎকার করে বলছিল, “পালাও, দিয়া! এটা স্বাভাবিক নয়। এটা বিপজ্জনক।” কিন্তু তার শিল্পীর মন, তার কৌতূহলী সত্তা তাকে টানছিল। এই দরজাটা হলো অজানার দিকে একটা আমন্ত্রণ, যা কোনো শিল্পী উপেক্ষা করতে পারে না।
তার দিদিমা কি এই জগতের কথা জানতেন? এই খাতাটা কি শুধু আলপনার বই, নাকি অন্য কোনো জগতের চাবিকাঠি?
এক মুহূর্তের জন্য সে তার কলকাতার ফ্ল্যাটের কথা, তার এগজিবিশনের কথা ভাবল। তারপর আবার তাকাল ওই আলোকময় দরজার দিকে। দুটো ভিন্ন জগৎ। একটা চেনা, নিরাপদ। অন্যটা অজানা, রহস্যময়।
অনেক দ্বিধার পর, একটা গভীর শ্বাস নিয়ে দিয়া তার ডান পা-টা বাড়াল। সে পা রাখল আলোর সেই দরজার ওপারে।
এক মুহূর্তের জন্য তার পৃথিবীটা ওলটপালট হয়ে গেল। তার মনে হলো সে যেন একটা বর্ণালী সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে। তার চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে লক্ষ কোটি রঙের কণা। তারপর হঠাৎ সব শান্ত হয়ে গেল।
দিয়া চোখ খুলল।
এবং যা দেখল, তার জন্য সে কোনোদিনও প্রস্তুত ছিল না।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion