চোখ খুলে দিয়া দেখল, সে একটা নরম, খয়েরি মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু পায়ের তলার অনুভূতিটা মাটির মতো নয়, মসৃণ ও শীতল—ঠিক যেন নতুন পোড়ানো মাটির উঠোন। সে একটা গভীর শ্বাস নিল। বাতাসটা আশ্চর্যরকম নির্মল আর তাতে মিশে আছে চন্দন, ধুনো আর ভেজা মাটির এক অপার্থিব সৌরভ। সে মাথা তুলে আকাশ দেখল এবং বিস্ময়ে তার শ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আকাশটা আকাশ নয়, যেন একটা বিশাল আকারের জড়ানো পটচিত্র ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। গাঢ় নীল পটভূমিতে তুলির মোটা টানে আঁকা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, আর দিগন্তের কাছে পটের ছবির মতোই একটা হলুদ সূর্য—যার মুখে দুটো চোখ আর একটা মৃদু হাসির রেখা—স্থির হয়ে আছে। সেই সূর্য থেকে যে আলো ছড়াচ্ছে, তা স্নিগ্ধ, তার কোনো তাপ নেই।
চারপাশের গাছপালাগুলোও অদ্ভুত। তাদের পাতাগুলো সবুজের বদলে গাঢ় লাল, নীল আর হলুদ রঙের, আর গাছের ডালপালাগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত যেন কোনো পটুয়া সযত্নে তাদের এঁকেছে। দিয়া একটা গাছের কান্ডে হাত দিল। মসৃণ, ঠান্ডা—ঠিক যেন বাঁকুড়ার টেরাকোটার ঘোড়ার গা। সে একজন শিল্পী হিসেবে এই জগতের শৈলীটা বোঝার চেষ্টা করছিল—গাঢ় রঙের বর্ডার, সপাট রঙের ব্যবহার, দ্বিমাত্রিক দৃষ্টিকোণ। এখানকার সবকিছুই ছিল শৈল্পিক, কিন্তু প্রাণহীন নয়। পাতার বিনুনিতে হাওয়ার শব্দ হচ্ছিল, যা শুনতে অনেকটা সেতারের নরম আলাপের মতো। এটা কোনো জঙ্গল নয়, এটা একটা আস্ত জীবন্ত শিল্পকর্ম।
কিন্তু এই মুগ্ধতার পাশাপাশি তার মনে ভয়ও কাজ করছিল। এটা কোন জায়গা? সে কি আর ফিরতে পারবে? তার ঠিক পিছনে, যেখানে আলোর দরজাটা ছিল, সেখানে এখন শুধু একটা সাধারণ ঘাসজমি। ফেরার পথ বন্ধ। একাকিত্ব আর অসহায়তার একটা ঠান্ডা স্রোত তার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল।
হঠাৎ একটা খসখস শব্দে তার চমক ভাঙল। সে দেখল, একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে এক বিচিত্র প্রাণী। প্রাণীটার মুখটা শেয়ালের মতো, কিন্তু তার সারা গায়ে ময়ূরের মতো উজ্জ্বল পালক। প্রাণীটা তাকে দেখে ভয় পেল না, বরং কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকিয়ে মাথাটা একপাশে কাত করল। তার পালকের রঙগুলো তরলের মতো বইতে শুরু করল, নীল থেকে সবুজ, সবুজ থেকে বেগুনি—যেন একটা জীবন্ত রঙধনু।
দিয়ার ভয় করছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করছিল অবাক। সে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ঠিক তখনই গাছের ডাল থেকে কেউ একজন輕স্বরে বলে উঠল, “ভয় পেয়ো না ওকে। ও হলো ‘মায়াশেয়াল’। শুধু রঙ বদলাতে ভালোবাসে। তোমার মনের রঙ যেমন, ও সেই রঙ ধারণ করে।”
দিয়া চমকে উঠে উপরে তাকাল। দেখল, একটা গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে এক যুবক। তার পরনে উজ্জ্বল কমলা রঙের ধুতি আর গায়ে জড়ানো সবুজ উত্তরীয়। শ্যামলা গায়ের রঙ, কোঁকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে, আর চোখ দুটোয় ঝিলিক দিচ্ছে দুষ্টুমি আর কৌতূহল। যুবকটি এক লাফে গাছ থেকে নিচে নেমে এল। তার মাটিতে পড়ার কোনো শব্দ হলো না, যেন একটা পালকের মতো ভেসে নামল। তার চলার ভঙ্গিতে একটা অদ্ভুত ছন্দ আছে।
সে হেসে বলল, “আমি কে, সেটা তো প্রতি মুহূর্তে বদলায়। কখনো আমি রাজা, কখনো ভিখারি। কখনো পাখি, আবার কখনো মেঘ। তবে এখানকার সবাই আমাকে কিংশুক বলে ডাকে। আমি একজন বহুরূপী। আর তুমি? তুমি তো মানুষলোকের মেয়ে, তাই না? তোমার চোখে আমি কলকাতার আকাশ দেখতে পাচ্ছি—ধোঁয়াশা, নিয়ন আলো আর ব্যস্ততার রঙ।”
দিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। “তুমি… তুমি কলকাতা চেনো?”
“চিনি মানে! তোমাদের গল্পগুলোই তো আমাদের প্রাণ। আমি তোমাদের রেলগাড়ির গল্প জানি, হাওড়া ব্রিজের গল্প জানি, এমনকি তোমাদের ওই যে নতুন উড়ালপুল—তার গল্পও শুনেছি,” কিংশুকের চোখেমুখে সরল উচ্ছ্বাস। “কিন্তু তুমি এখানে এলে কী করে? রক্ষকের পর তো আর কেউ আসেনি।”
“রক্ষক?” দিয়া কিছুই বুঝতে পারছিল না। “আমি জানি না আমি কোথায়। আমি শুধু দিদিমার খাতা থেকে একটা আলপনা এঁকেছিলাম, আর…”
কিংশুকের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। তার চঞ্চল চোখে ফুটে উঠল গভীর উদ্বেগ। সে দিয়ার কাছে এগিয়ে এল। “তুমি কি মালতী-রক্ষকের নাতনি?”
“মালতী আমার দিদিমার নাম ছিল। কিন্তু রক্ষক মানে কী?”
কিংশুক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারদিকে তাকাল, যেন কেউ তাদের কথা শুনছে কি না দেখছে। তারপর নিচু গলায় বলল, “তুমি এসেছ কল্পলোকে। এই জগৎটা তোমাদের পৃথিবীর মানুষের বিশ্বাস, গল্প আর শিল্প দিয়ে তৈরি। কিন্তু তুমি খুব ভুল সময়ে এসেছ, মানুষলোকের মেয়ে। আমাদের জগৎ বিপদে পড়েছে।”
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion