কিংশুক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারদিকে তাকাল, যেন কেউ তাদের কথা শুনছে কি না দেখছে। তারপর নিচু গলায় বলল, “তুমি এসেছ কল্পলোকে। এই জগৎটা তোমাদের পৃথিবীর মানুষের বিশ্বাস, গল্প আর শিল্প দিয়ে তৈরি। কিন্তু তুমি খুব ভুল সময়ে এসেছ, মানুষলোকের মেয়ে। আমাদের জগৎ বিপদে পড়েছে।”
“বিপদ? কীসের বিপদ?” দিয়া কিংশুকের কথার গভীরতা মাপার চেষ্টা করছিল। ছেলেটার হাবভাব হালকা হলেও, তার চোখের দৃষ্টিতে একটা ভারিক্কি ভাব ছিল, যা তার বয়সের সঙ্গে বেমানান।
কিংশুক একটা বড় পাথরের উপর বসল, যেটা দেখতে অনেকটা কচ্ছপের মতো। সে দিয়াকেও বসতে ইঙ্গিত করল। “এই যে আমাদের জগৎ দেখছ—এই পটচিত্রের আকাশ, এই টেরাকোটার গাছ—এগুলো সবই তোমাদের পৃথিবীর মানুষের কল্পনার প্রতিফলন। যতদিন তোমাদের পৃথিবীতে শিল্পীরা পট আঁকতেন, ছুতোররা কাঠের পুতুল গড়তেন, মায়েরা ঘুমপাড়ানি গান গাইতেন, ততদিন আমাদের জগৎ প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছিল। যখন কোনো শিশু পক্ষীরাজ ঘোড়ার স্বপ্ন দেখত, তখন আমাদের পক্ষীরাজের ডানায় একটা নতুন পালক গজিয়ে উঠত।”
সে হাত দিয়ে দূরের একটা পাহাড় দেখাল, যা দেখতে অনেকটা সরা-চিত্রের মতো। পাহাড়ের গায়ে আঁকা একটা झरना, কিন্তু তার জল স্থির। “আগে ওই झरना থেকে সুরের শব্দ শোনা যেত,” কিংশুক বিষণ্ণ গলায় বলল। “কিন্তু এখন?” তার গলায় হতাশার সুর। “এখন তোমাদের পৃথিবীতে নতুন গল্প তৈরি হয় না। পুরনো গল্পগুলোও কেউ মনে রাখে না। তোমাদের শিশুরা এখন যন্ত্রের পর্দায় চোখ রাখে। তাদের কল্পনাগুলো আমাদের কাছে পৌঁছায় না। তাই আমাদের জগৎ ধীরে ধীরে শক্তি হারাচ্ছে। বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে।”
দিয়া এই প্রথম ভালো করে খেয়াল করল। কিংশুকের উজ্জ্বল কমলা ধুতিটার রঙ জায়গায় জায়গায় কেমন যেন ফ্যাকাশে। যে গাছটার নিচে তারা বসেছিল, তার কয়েকটা পাতা স্বচ্ছ, প্রায় অদৃশ্য হতে বসেছে। তার শিল্পী-চোখ এতক্ষণ শুধু সৌন্দর্য দেখেছিল, তার পেছনের ক্ষয়টা দেখতে পায়নি।
“আমার দিদিমা… তিনি কী করতেন?” দিয়া জানতে চাইল।
“মালতী-রক্ষক ছিলেন দুই জগতের মধ্যে সেতুর মতো। তিনি আলপনার শক্তিতে আমাদের জগতকে প্রাণশক্তি পাঠাতেন। তিনি নতুন গল্প বুনতেন, পুরনো শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতেন। তিনি ছিলেন আমাদের শেষ রক্ষাকর্তা,” কিংশুক বলল। “তার আলপনা শুধু দরজা খুলত না, সেগুলো ছিল আরোগ্যের মন্ত্র, সুরক্ষার বর্ম। একবার আমাদের ‘রূপকথা’ নদীটা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল। মালতী-রক্ষক এসে নদীর তীরে একটা মাছের আলপনা এঁকেছিলেন। সেই আলপনার শক্তিতে নদী আবার জলে ভরে উঠেছিল।”
কিংশুক উঠে দাঁড়াল। “তোমাকে একজনের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তিনি সবটা আরও ভালো করে বোঝাতে পারবেন। তার নাম বেঙ্গমা-ঠাকুর। তিনি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ এবং জ্ঞানী।”
“বেঙ্গমা-ঠাকুর? মানে বেঙ্গমা-বেঙ্গমির গল্পের…?”
“হ্যাঁ,” কিংশুক হাসল। “আমাদের এখানে সব গল্পই সত্যি। কিন্তু পথটা সহজ নয়। আমাদের সাবধানে যেতে হবে।”
“সাবধানে? কেন?”
“কারণ, আমাদের জগৎ দুর্বল হয়ে পড়ায় ‘ছায়া’রা শক্তিশালী হয়ে উঠছে,” কিংশুকের গলার স্বর আবার বদলে গেল, হয়ে উঠল গম্ভীর। “ছায়ারা হলো ভুলে যাওয়া, পরিত্যক্ত কল্পনা। যে গল্পগুলো কেউ বলে না, যে গান কেউ গায় না, সেই না-বলা কথাদের অভিমান আর হতাশা থেকে ওদের জন্ম। ওরা আলো আর রঙ সহ্য করতে পারে না। ওরা আমাদের জগতের প্রাণশক্তি শুষে নিতে চায়, আর সুযোগ পেলে তোমাদের জগতেও হানা দিতে চায়।”
দিয়ার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তার মনে পড়ল, কলকাতায় তার আঁকা ‘টেকনো-মিথ’ সিরিজের ছবিগুলো—যেখানে সে পক্ষীরাজকে বানিয়েছিল ডানাওলা মোটরবাইক, আর বেঙ্গমা-বেঙ্গমিকে বানিয়েছিল নজরদারি ড্রোন। সে কি নতুন কল্পনা তৈরি করছিল, নাকি পুরনো কল্পনাগুলোকে নিজের অজান্তেই ধ্বংস করে দিচ্ছিল? এই ছায়াদের জন্মানোর পেছনে কি তারও কোনো ভূমিকা আছে? একটা তীব্র অপরাধবোধ তাকে ঘিরে ধরল।
“চলো, আর দেরি করা ঠিক হবে না,” কিংশুক তাড়া দিল। “সূর্য ডোবার আগেই আমাদের ‘পাখিদের গ্রাম’-এ পৌঁছাতে হবে।”
দিয়া উঠে দাঁড়াল। তার ভয়, বিস্ময়, আর অপরাধবোধ—সব অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। সে কিংশুকের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল এক অজানা, বিপদসঙ্কুল পথের দিকে, যার প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে ছিল তার নিজেরই শিকড়ের গল্প।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion