কিংশুকের সাথে পথ চলতে চলতে দিয়া কল্পলোকের আরও গভীরে প্রবেশ করছিল। এই জগৎটা যতটা সুন্দর, ততটাই ভঙ্গুর। তারা একটা নদী পার হলো, যার জল রুপোর মতো তরল আর তাতে কাগজের নৌকার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে শত শত পদ্মপাতা। কিংশুক বলল, এই নদীর নাম ‘রূপকথা’। কিন্তু দিয়া দেখল, নদীর জল জায়গায় জায়গায় ঘোলাটে, আর কিছু পদ্মপাতা কিনারা থেকে ছিঁড়ে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।
নদীর ওপারে একটা গ্রাম। গ্রামের বাড়িগুলো সব পোড়ামাটির তৈরি, তাদের দেওয়ালে আর চালে লতাপাতার আশ্চর্য নকশা। দিয়া দেখল, গ্রামের মেয়েরা নদীর ঘাট থেকে জল নিয়ে যাচ্ছে মাটির কলসিতে করে, কিন্তু তাদের শাড়ির রঙ বড্ড ফ্যাকাশে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছিল, কিন্তু তাদের হাসিতে যেন প্রাণ নেই, তাদের দৌড়াদৌড়িতে কোনো গতি নেই। একজন কুমোর তার চাকার সামনে বসে ছিল, কিন্তু সে মাটির তালটাকে কোনো আকার দিতে পারছিল না। মাটিটা বারবার ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছিল।
“দেখছ?” কিংশুক ফিসফিস করে বলল। “এটাই আমি বলছিলাম। এই গ্রামের নাম ‘টেরাকোটা টুলি’। এখানকার বাসিন্দাদের গায়ের রঙও ছিল পোড়ামাটির মতো উজ্জ্বল, এখন কেমন ছাইরঙা হয়ে গেছে।”
দিয়ার বুকটা ব্যথায় টনটন করে উঠল। তার মনে হলো, এই মানুষগুলোর এই অবস্থার জন্য সে-ও কিছুটা দায়ী। তার মতো নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাই তো ঐতিহ্যকে ‘সেকেলে’ বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
তারা গ্রাম ছাড়িয়ে একটা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকল। এই জঙ্গলের গাছগুলো কাঠের পুতুলের মতো, তাদের ডালপালাগুলো জোড়ায় জোড়ায় এমনভাবে লাগানো যেন কোনো কারিগর তৈরি করেছে। গাছে গাছে অদ্ভুত দর্শন পাখিরা বসেছিল, কিন্তু তাদের কোনো ডাক শোনা যাচ্ছিল না। সব কিছু কেমন নিস্তব্ধ, নিথর। হঠাৎ করেই কিংশুক দিয়ার হাত ধরে টেনে তাকে একটা বিশাল গাছের আড়ালে নিয়ে গেল। “চুপ! কোনো শব্দ কোরো না,” সে ইশারা করল।
বাতাসটা হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল। জঙ্গলের সব শব্দ থেমে গেল। দিয়া দেখল, তাদের থেকে কিছুটা দূরে, জঙ্গলের মধ্যে একটা ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। মূর্তিটার কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই, ঘন কালো ধোঁয়ার মতো। কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে আবছাভাবে মানুষের মুখের মতো আকৃতি ফুটে উঠছিল আর মিলিয়ে যাচ্ছিল—যেন অনেকগুলো ভুলে যাওয়া মুখ একসাথে আর্তনাদ করছে। সেটা যেখান দিয়ে যাচ্ছে, সেখানকার মাটি আর গাছপালা যেন রঙ হারিয়ে সাদা-কালো হয়ে যাচ্ছে। একটা রঙিন প্রজাপতি তার সামনে পড়েছিল, ছায়াটা তার ওপর দিয়ে চলে যেতেই প্রজাপতিটা ধূসর ছাই হয়ে ঝরে পড়ল।
“ওটাই ‘ছায়া’,” কিংশুক প্রায় নিঃশব্দে বলল। “ওরা এখন জঙ্গলে আর জনবসতিতে আসতে শুরু করেছে। আগে ওরা শুধু ‘ভুলে যাওয়া উপত্যকা’-তেই থাকত।”
দিয়ার সারা শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল। এই প্রথম সে কল্পলোকের আসল বিপদটা নিজের চোখে দেখল। এটা শুধু রঙ হারানোর গল্প নয়, এটা অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার সংকট।
ছায়াটা মিলিয়ে যাওয়ার পর তারা আবার হাঁটতে শুরু করল, কিন্তু এবার তাদের চলার গতি বেড়ে গেল। দিয়ার মনে তখন হাজারো প্রশ্ন। সে কি পারবে তার দিদিমার মতো হতে? সে কি আদৌ জানে আলপনার আসল শক্তি? সে তো শুধু একজন ডিজিটাল আর্টিস্ট। চালের গুঁড়ো দিয়ে ছবি আঁকা তার কাজ নয়।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর তারা একটা বিশাল বটগাছের নিচে এসে পৌঁছাল। গাছটা এত বড় যে তার ডালপালাগুলো আকাশকে ঢেকে দিয়েছে, আর তার ঝুরিগুলো নেমে এসে মাটির মধ্যে নতুন কান্ড তৈরি করেছে। গাছটাকে দেখে একটা আস্ত চলমান দুর্গ বলে মনে হচ্ছিল। গাছের গোড়ায় একটা বিশাল কোটর, যা দেখতে অনেকটা মন্দিরের প্রবেশদ্বারের মতো।
“আমরা পৌঁছে গেছি,” কিংশাঙ্ক বলল। “এটাই বেঙ্গমা-ঠাকুরের আশ্রম।”
দিয়া কোটরের দিকে তাকাল। ভেতরটা অন্ধকার। কিন্তু সেই অন্ধকার থেকে ভেসে আসছিল হাজার হাজার পাখির কলকাকলি, যা এতক্ষণ ধরে জঙ্গলে অনুপস্থিত ছিল। মনে হচ্ছিল, কল্পলোকের সমস্ত পাখিরা যেন ওই একটি গাছের কোটরে আশ্রয় নিয়েছে।
একটু দ্বিধা, একটু ভয়, আর একরাশ আশা নিয়ে দিয়া কিংশুকের সাথে সেই অন্ধকার কোটরের ভেতরে পা রাখল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion