বটগাছের কোটরের ভেতরের অন্ধকারটা ছিল क्षणস্থায়ী। কয়েক পা এগোতেই দিয়ার চোখ এক নরম, স্নিগ্ধ আলোয় অভ্যস্ত হয়ে উঠল। সে বিস্ময়ে দেখল, তারা কোনো গাছের কোটরে নয়, বরং এক বিশাল, প্রাকৃতিক সভাগৃহে এসে পড়েছে। গাছের মোটা মোটা শিকড়গুলো খিলানের মতো উপরে উঠে গিয়ে একটা ছাদ তৈরি করেছে, আর ঝুরিগুলো নেমে এসে তৈরি করেছে অসংখ্য থাম। দেওয়াল জুড়ে জ্বলজ্বল করছে স্বপ্রভ শৈবাল, যার মৃদু সবুজ আলোয় চারপাশ আলোকিত। বাতাসটা ছিল হাজারো পাখির কলতানে মুখরিত, কিন্তু কোলাহল নয়, বরং একটা আশ্চর্য ঐকতান সৃষ্টি করছিল সেই শব্দ। দিয়ার মনে হলো, সে যেন একটা জীবন্ত গির্জায় এসে পড়েছে, যেখানে প্রকৃতির স্থাপত্য আর পাখিদের সঙ্গীত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বাতাসের প্রতিটা কণায় ছিল ভেজা মাটি, পুরোনো কাঠ আর বুনো ফুলের এক মিষ্টি সৌরভ।
গাছের বিভিন্ন স্তরে, ডালে ডালে, শিকড়ের ভাঁজে বাসা বেঁধেছে কল্পলোকের সমস্ত পাখিরা। দিয়া দেখল টুনটুনি, দোয়েল, শ্যামা, নীলকণ্ঠ— আরও কত অজানা রঙের, অজানা নামের পাখি। একদল সোনালী ডানার মৌটুসি শৈবালের আলো থেকে মধু সংগ্রহ করছিল, তাদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে বাতাসে একটা মৃদু গুঞ্জন ভাসছিল। তারা ভয় পেয়ে উড়ে যাচ্ছিল না, বরং কৌতূহলী চোখে নতুন অতিথির দিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ ছোট্ট একটা টুনটুনি উড়ে এসে দিয়ার কাঁধের উপর বসল। তার নরম পালকের স্পর্শে দিয়ার শরীর কেঁপে উঠল। পাখিটা কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার উড়ে গেল, কিন্তু তার এই ছোট্ট স্বাগত জানানোর ভঙ্গিটা দিয়ার মনের ভয়কে অনেকটাই কমিয়ে দিল।
“এদিকে,” কিংশুক তাকে একটা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল, যা তৈরি হয়েছে দুটো বিশাল শিকড়ের মাঝখান দিয়ে।
তারা এসে পৌঁছাল सभागৃহের ঠিক মাঝখানে। সেখানে একটা বিশাল, মসৃণ পাথরের উপর বসেছিলেন এক বৃদ্ধ। কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তাঁর মুখমন্ডল ছিল মানুষের মতোই, কিন্তু তাতে ছিল পাখির মতো তীক্ষ্ণতা। তাঁর নাকটা ছিল ঈগলের মতো বাঁকানো, আর চোখ দুটো ছিল পেঁচার মতো গোল ও গভীর, যার মণিটা অন্ধকারেও প্রদীপের মতো জ্বলছিল। তাঁর শরীর ছিল শীর্ণ, কিন্তু ঋজু। পরনে ছিল গাছের ছালের মতো দেখতে वस्त्र, আর তাঁর কাঁধ থেকে নেমে এসেছে পাখির পালকের মতো একটা লম্বা চাদর, যার রঙ গোধূলির আকাশের মতো—কমলা, বেগুনি আর নীলের মিশ্রণ।
তিনি চোখ বুজে ধ্যান করছিলেন। তাদের আগমনে তিনি চোখ খুললেন। সেই চোখে ছিল অনন্ত কালের জ্ঞান আর গভীর বিষণ্ণতা। দিয়ার মনে হলো, এই চোখ দুটো যেন কল্পলোকের জন্ম থেকে শুরু করে তার আজকের এই ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা—সবকিছু চাক্ষুষ দেখেছে। বৃদ্ধের উপস্থিতিটা ছিল শান্ত, কিন্তু এতই শক্তিশালী যে দিয়ার মনে হলো তার চারপাশের বাতাসটা পর্যন্ত ভারী হয়ে উঠেছে।
“এসেছ, মালতীর নাতনি,” তাঁর গলার স্বর ছিল পাখির ডাকের মতোই সুরেলা, কিন্তু গম্ভীর ও বহুদূর থেকে ভেসে আসা শব্দের মতো। “তোমার জন্য অনেক কাল ধরে অপেক্ষা করছি।”
দিয়া অবাক হয়ে গেল। “আপনি… আপনি আমাকে চেনেন?”
“আমি বেঙ্গমা-ঠাকুর,” বৃদ্ধ উত্তর দিলেন। “কল্পলোকের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের সুতো আমার চোখে ধরা দেয়। আমি তোমায় তোমার জন্মের আগে থেকেই চিনি। আমি জানতাম, একদিন তুমি আলপনার ডাক শুনতে পাবে।”
কিংশুক বেঙ্গমা-ঠাকুরকে প্রণাম করে একপাশে সরে দাঁড়াল। দিয়া কী করবে বুঝতে না পেরে শুধু হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইল। তার শহুরে মন এই অবিশ্বাস্য দৃশ্যকে যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারছিল না।
“তোমার মনে অনেক প্রশ্ন, দেখতে পাচ্ছি আমি,” বেঙ্গমা-ঠাকুর বললেন। “কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় হয়তো আমাদের হাতে নেই। কল্পলোক আজ বিপন্ন, আর তার ছায়া তোমাদের জগতেও পড়তে শুরু করেছে।”
বেঙ্গমা-ঠাকুর তাঁর হাতটা পাশের একটা ছোট জলাশয়ের দিকে বাড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই জলাশয়ের স্থির জলে ছবি ফুটে উঠল। দিয়া দেখল, কল্পলোকের বিভিন্ন প্রান্ত—সেই বিবর্ণ টেরাকোটা গ্রাম, যেখানে কুমোর হতাশ হয়ে তার চাকা দেখছে; সেই রঙহীন কাঠের পুতুলের জঙ্গল, যেখানে একটা অসমাপ্ত পুতুল এক ফোঁটা রঙের জন্য কাঁদছে; এমনকি শুকিয়ে যাওয়া ‘রূপকথা’ নদী, যার বুকে মরে পড়ে আছে রুপোলি মাছ। ছবিগুলো কাঁপছিল, যেন যেকোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে।
“এই হলো আমাদের বর্তমান,” বেঙ্গমা-ঠাকুরের গলায় গভীর দুঃখ। “আমাদের জগৎ হলো একটা স্বপ্নের বস্ত্র। আর সেই বস্ত্রের সুতো হলো তোমাদের পৃথিবীর মানুষের কল্পনা। সেই সুতোর জোগান আজ প্রায় বন্ধ। তাই আমাদের এই বস্ত্র ছিঁড়ে যাচ্ছে, রঙ হারাচ্ছে।”
“আর এই ছায়ারা?” দিয়া জিজ্ঞেস করল।
“যখন কোনো গল্প হারিয়ে যায়, যখন কোনো শিল্পীর আঁকা ছবি অসমাপ্ত থেকে যায়, যখন কোনো গান মাঝপথে থেমে যায়—তখন জন্ম নেয় হতাশা। সেই হতাশা, সেই অভিমান, সেই শূন্যতাই হলো ছায়া,” বেঙ্গমা-ঠাকুর ব্যাখ্যা করলেন। “আর এই সমস্ত ছায়াদের আজ একজন রাজা আছে—ছায়াপতি।”
জলাশয়ের জলে এবার এক নতুন ছবি ভেসে উঠল। এক অন্ধকার সিংহাসনে বসে আছে এক ছায়ামূর্তি। তার অবয়ব স্পষ্ট নয়, কিন্তু তার শরীর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে ঠান্ডা, নীল আভা। তার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো ছায়ার দল।
“ছায়াপতি একসময় আমাদেরই একজন ছিল,” বেঙ্গমা-ঠাকুর বলতে লাগলেন। “তার নাম ছিল ‘মনন’। সে ছিল কল্পলোকের শ্রেষ্ঠ গল্পকার। তার কল্পনা থেকে জন্ম নিত নতুন নতুন চরিত্র, নতুন নতুন জগৎ। সে ‘ঘুম-পাখি’র গল্প লিখেছিল, যে পাখি গান গাইলে শিশুরা হাসিমুখে ঘুমিয়ে পড়ত। সে ‘সাহসী জোনাকি’র গল্প বুনেছিল, যে তার ছোট্ট আলো দিয়ে অমাবস্যার অন্ধকার দূর করত।”
জলের ছবিতে ভেসে উঠল এক তরুণের মুখ, যার চোখে ছিল সৃষ্টির আনন্দ। সে তার চারপাশে বসা কল্পলোকের শিশুদের গল্প শোনাচ্ছে।
“কিন্তু মানুষলোকে তার গল্পগুলো ধীরে ধীরে সবাই ভুলে গেল। নতুন প্রজন্মের কাছে তার কাহিনীরা পুরনো, অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠল। এই প্রত্যাখ্যান, এই বিস্মৃতি মননকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছিল। ভালোবাসার বদলে ঘৃণা, সৃষ্টির বদলে ধ্বংস তার মনকে গ্রাস করল। ভোলার যন্ত্রণায় সে পরিণত হলো ছায়াপতিতে।”
জলের ছবিটা বদলে গেল। সেই আনন্দময় তরুণ এখন এক যন্ত্রণাকাতর সত্তা। তার চারপাশে তার নিজের সৃষ্টিরাই মিলিয়ে যাচ্ছে, ধুলো হয়ে যাচ্ছে। তার আর্তনাদ যেন দিয়া নিজের কানে শুনতে পেল।
“সে কী চায়?” দিয়ার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।
“সে দুই জগৎকে এক করে দিতে চায়,” বেঙ্গমা-ঠাকুর উত্তর দিলেন। “তবে ভালোবেসে নয়, জোর করে। সে আলপনার দরজাগুলোকে ভেঙে ফেলে একটা স্থায়ী পথ তৈরি করতে চায়, যার মাধ্যমে সে মানুষলোকের সমস্ত প্রাণশক্তি, সমস্ত কল্পনা শুষে নিয়ে তার ছায়ারাজ্যকে অমর করে রাখবে। আর তা যদি হয়, তবে তোমাদের পৃথিবীও একটা বিবর্ণ, অনুভূতিহীন ছায়ারাজ্যে পরিণত হবে।”
দিয়ার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। তার মনে হলো, এই ছায়াপতির জন্মের পেছনে তার নিজেরও দায় আছে। তার ‘টেকনো-মিথ’, তার পুরনোকে অস্বীকার করার জেদ—এ সবই তো মননের মতো স্রষ্টাদের যন্ত্রণার কারণ।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion