Episode 81282 words0 views

অষ্টম অধ্যায় : রক্ষকের পথ

“আমার দিদিমা এসব জানতেন?” দিয়া কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল। “মালতী সব জানত,” বেঙ্গমা-ঠাকুর বললেন। “সে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেছে। সে একা হাতে আলপনার বর্ম তৈরি করে কল্পলোককে রক্ষা করেছে। কিন্তু সে জানত, তার একার শক্তি যথেষ্ট নয়। তাই সে তার সমস্ত জ্ঞান ওই খাতায় লিপিবদ্ধ করে গেছে। সে অপেক্ষা করছিল তার উত্তরসূরির জন্য। তোমার জন্য।” “কিন্তু আমি?” দিয়া প্রায় চিৎকার করে উঠল। “আমি তো এসবের কিছুই জানি না! আমি আলপনা আঁকতে পারি না! আমি চালের গুঁড়ো দিয়ে পৃথিবীকে বাঁচাতে পারব না! আমি শুধু একজন ডিজিটাল আর্টিস্ট! আমার জগৎ হল পিক্সেল আর কোডের, চালের গুঁড়ো আর মাটির নয়!” তার গলার স্বরে ছিল ভয়, দ্বিধা আর অপারগতার কান্না। “শিল্প মাধ্যম নয়, শিল্পীর দৃষ্টিটাই আসল,” বেঙ্গমা-ঠাকুর শান্তভাবে বললেন। “তুমি যা দিয়ে রেখা টানো—ডিজিটাল পেন বা আঙুলের ডগা—তা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, তুমি সেই রেখায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারো কি না। তোমার রক্তে মালতীর উত্তরাধিকার বইছে। কিন্তু সেই শক্তিকে তোমাকেই জাগাতে হবে।” তিনি দিয়ার দিকে তাঁর শীর্ণ হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটা ছোট মাটির থলি। “শুধু রক্ষকের বংশধর হলেই চলবে না। তোমাকে রক্ষকের পথ বেছে নিতে হবে, দিয়া। এটা তোমার সিদ্ধান্ত।” দিয়া এক মুহূর্ত দ্বিধা করল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কলকাতার নিরাপদ জীবন, তার স্বপ্ন, তার ভবিষ্যৎ। আর অন্যদিকে এই মায়াবী, বিপন্ন জগৎ, যার অস্তিত্ব তার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। সে টেরাকোটা গ্রামের সেই প্রাণহীন শিশুদের মুখ মনে করল, সেই ছাই হয়ে যাওয়া প্রজাপতিটার কথা ভাবল। সে আর দ্বিধা করল না। এগিয়ে গিয়ে বেঙ্গমা-ঠাকুরের হাত থেকে থলিটা নিল। থলিটা হাতে নিতেই তার সারা শরীরে একটা মৃদু উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল, যেন মাটি নিজেই তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। বেঙ্গমা-ঠাকুরের মুখে একটা মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। “এই থলিতে আছে ‘প্রাণের বীজ’। যেখানে ছায়ারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে, সেখানে এই বীজ পুঁতে তার চারপাশে তোমাকে ‘আরোগ্যের আলপনা’ আঁকতে হবে। দিদিমার খাতায় তার নকশা তুমি খুঁজে পাবে। এটাই তোমার প্রথম পরীক্ষা।” তিনি কিংশুকের দিকে তাকালেন। “কিংশুক, তুমি ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও ‘বিষণ্ণ উপত্যকা’-য়। ওখানেই ছায়াপতির শক্তি সবচেয়ে বেশি।” “কিন্তু ঠাকুর,” কিংশুক উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “ওখানে যাওয়া তো খুব বিপজ্জনক!” “রক্ষকের পথ কোনোদিনই সহজ নয়,” বেঙ্গমা-ঠাকুর বললেন। “এখন যাও। সময় খুব কম।” দিয়া আর কিংশুক বেঙ্গমা-ঠাকুরকে প্রণাম করে সেই सभागৃহ থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে তখন পটচিত্রের আকাশে সন্ধ্যা নামছে। দিয়ার হাতে ধরা মাটির থলি, আর বুকে একরাশ ভয় আর এক নতুন সঙ্কল্প। সে আর কলকাতার সেই সাধারণ মেয়েটা নেই। সে এখন কল্পলোকের নতুন রক্ষক। এক অজানা, ভয়ঙ্কর যাত্রার দিকে সে তার প্রথম পদক্ষেপ ফেলল। বেঙ্গমা-ঠাকুরের আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসার পর পটচিত্রের আকাশে সন্ধ্যা নেমেছিল। সেই হলুদ হাসিমুখ সূর্যটা দিগন্তে ডুবে গেছে, আর তার জায়গায় আকাশে ফুটে উঠেছে হাজারো রুপোর টিপের মতো তারা। কিন্তু সেই তারাগুলো থেকে কোনো আলো আসছিল না, বরং তাদের উপস্থিতি আকাশকে আরও বেশি অন্ধকার করে তুলেছিল। “বিষণ্ণ উপত্যকা এখান থেকে অনেক দূর,” কিংশুক বলল। তার গলার স্বরে আর আগের মতো সেই উচ্ছলতা ছিল না। “আমাদের সারারাত হাঁটতে হবে।” তারা এমন একটা অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিল, যা দিয়া আগে দেখেনি। এখানকার গাছপালাগুলো ছিল কাঁটা ঝোপের মতো, আর মাটি ছিল শুকনো ও পাথুরে। বাতাসটা ছিল ভারী আর ঠান্ডা। কিংশুক বলল, এই জায়গার নাম ‘দীর্ঘশ্বাসের প্রান্তর’। কোনো গল্প যখন শেষ হওয়ার আগে থেমে যায়, তখন তার শেষ না হওয়া দীর্ঘশ্বাসগুলো এখানে এসে জমা হয়। দিয়ার কানে যেন সত্যি সত্যিই হাজারো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছিল। দিয়া তার ব্যাগ থেকে দিদিমার খাতাটা বের করল। হাঁটতে হাঁটতেই সে পাতা ওল্টাতে লাগল ‘আরোগ্যের আলপনা’র খোঁজে। অবশেষে সে পেল। নকশাটা ছিল খুব সুন্দর কিন্তু জটিল। একটা central বিন্দুকে ঘিরে অনেকগুলো বৃত্তাকার পাপড়ি ছড়িয়ে পড়েছে, অনেকটা সূর্যমুখী ফুলের মতো। আর প্রতিটি পাপড়ির ভেতরে আঁকা ছোট ছোট জীবনের প্রতীক—অঙ্কুরিত বীজ, উড়ন্ত পাখি, সাঁতার কাটা মাছ। দিয়া তার শিল্পীমন দিয়ে নকশাটাকে বোঝার চেষ্টা করল—এর জ্যামিতি, এর ছন্দ। “এই আলপনাটা আমি আঁকতে পারব তো?” দিয়ার মনে আবার সংশয় দেখা দিল। “পারবে,” কিংশুক তার দিকে না তাকিয়েই বলল। “তোমার দিদিমা বলতেন, আলপনা আঁকতে হয় মন দিয়ে, হাত দিয়ে নয়। তুমি শুধু মনটাকে স্থির রেখো।” অনেকক্ষণ হাঁটার পর তারা একটা পাহাড়ের কিনারায় এসে দাঁড়াল। নিচে একটা বিশাল উপত্যকা। কিন্তু চাঁদের আলোতেও সেখানে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সব কিছু ঘন, আঠালো অন্ধকারে ঢাকা। সেখান থেকে একটা ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে হাওয়া উপরে উঠে আসছিল, যাতে ছিল পচা পাতার গন্ধ। “ওই যে,” কিংশুক আঙুল দিয়ে দেখাল। “বিষণ্ণ উপত্যকা। একসময় এখানে কল্পলোকের সবচেয়ে সুন্দর ফুল ফুটত, ‘আনন্দ মঞ্জরী’। এখন সেখানে শুধু ছায়াদের বাস।” তারা সাবধানে পাথুরে পথ বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। যত নিচে নামছিল, ততই ঠান্ডা বাড়ছিল। দিয়ার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলছে—হতাশার কথা, পরাজয়ের কথা। “তুই পারবি না,” “ফিরে যা,” “তোর জন্য সব শেষ হয়ে যাবে।” “মন শক্ত রাখো,” কিংশুক সতর্ক করল। “ছায়ারা মনের দুর্বল জায়গায় আঘাত করে।” অবশেষে তারা উপত্যকার সমতল ভূমিতে পৌঁছাল। মাটিটা ছিল নরম আর স্পঞ্জের মতো, যেন প্রাণহীন। চারদিকে মরা গাছের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। কোনো শব্দ নেই, এমনকি ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকও না। এটা ছিল একটা মৃত জগৎ। উপত্যকার ঠিক মাঝখানে একটা বিরাট ফাঁকা জায়গা। কিংশুক বলল, “এটাই সঠিক জায়গা।” দিয়া তার কাঁধের ঝোলা থেকে বেঙ্গমা-ঠাকুরের দেওয়া মাটির থলিটা বের করল। কাঁপা কাঁপা হাতে সে থলির মুখ খুলল। ভেতরে ছিল ছোট্ট একটা বীজ, যা অন্ধকারেও মৃদু সোনারঙা আলো ছড়াচ্ছিল। সে মাটিতে একটা ছোট গর্ত করে বীজটা পুঁতে দিল। তারপর সে চালের গুঁড়োর বাটিটা বের করল। কিন্তু এই পরিবেশে, এই ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতার মধ্যে তার হাত চলছিল না। তার মনে হচ্ছিল, তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হবে। সে পারবে না। “দিয়া! কী ভাবছ?” কিংশুকের চিৎকারে দিয়ার ঘোর কাটল। সে দেখল, উপত্যকার চারপাশ থেকে কালো ছায়ারা ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই, কিন্তু তাদের সম্মিলিত গুঞ্জন দিয়ার আত্মবিশ্বাসকে চুরমার করে দিচ্ছিল। “আমি… আমি পারছি না, কিংশুক!” দিয়ার গলা দিয়ে কান্নার মতো স্বর বেরিয়ে এল। “আমার ভয় করছে!” “ভয়কে জয় করতে হবে না, দিয়া। ভয়টাকে স্বীকার করে নিয়ে তার পাশেই নিজের কাজটা করে যেতে হবে। চোখ বন্ধ করো। তোমার দিদিমার কথা ভাবো। ভাবো, কেন তুমি এটা করছ,” কিংশুক বলল। সে তার কোমরের উত্তরীয়টা খুলে হাওয়ায় ঘোরাতে লাগল। উত্তরীয়টা একটা উজ্জ্বল সবুজ আলোর চক্রে পরিণত হয়ে ছায়াদের কিছুক্ষণের জন্য আটকে রাখল। দিয়া চোখ বন্ধ করল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল ‘টেরাকোটা টুলি’র সেই রঙহীন শিশুদের মুখ, ছাই হয়ে যাওয়া প্রজাপতিটা। সে ভাবল, যদি সে আজ হেরে যায়, তবে শুধু কল্পলোক নয়, তার নিজের পৃথিবীও একদিন এই বিষণ্ণ উপত্যকার মতো প্রাণহীন হয়ে যাবে। সে চোখ খুলল। তার দৃষ্টি اب স্থির। সে আঙুলের ডগা চালের গুঁড়োর পেস্টে ডোবাল এবং পুঁতে দেওয়া বীজের চারপাশে প্রথম রেখাটা টানল। যে মুহূর্তে প্রথম রেখাটা আঁকা হলো, সঙ্গে সঙ্গে মাটি থেকে একটা মৃদু আলো বেরিয়ে এল। ছায়ারা ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল। এটা দেখে দিয়ার সাহস বাড়ল। সে আরও দ্রুত, আরও মন দিয়ে আঁকতে লাগল। তার আঙুলগুলো যেন নিজে থেকেই চলছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে একা নয়, তার দিদিমার হাতও যেন তার হাতের উপর রাখা আছে। একটা পাপড়ি, দুটো পাপড়ি, তিনটে পাপড়ি… আলপনাটা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ হচ্ছিল। প্রতিটা রেখার সাথে সাথে মাটি থেকে বেরোনো আলোর তেজ বাড়ছিল। চারপাশটা একটা নরম, সোনালী আলোয় ভরে যাচ্ছিল। ছায়ারা এবার মরিয়া হয়ে উঠল। তারা কিংশুকের সবুজ আলোর বর্ম ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছিল। কিংশুক ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। “দিয়া, তাড়াতাড়ি করো!” সে চিৎকার করল। দিয়া তখন আলপনার শেষ রেখাটা টানছে। যেই না শেষ বৃত্তটা সম্পূর্ণ হলো, একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। পুরো আলপনাটা দপ করে জ্বলে উঠল। সোনালী আলোর একটা তীব্র ঢেউ উপত্যকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। সেই আলোর স্পর্শে ছায়ারা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল এবং ধোঁয়ার মতো বাতাসে মিলিয়ে গেল। যে মরা গাছগুলো দাঁড়িয়েছিল, তাদের ডালে ডালে সবুজ কচি পাতা গজিয়ে উঠল। পায়ের তলার নরম, স্পঞ্জের মতো মাটিটা শক্ত ও উর্বর হয়ে উঠল। আর যে জায়গায় দিয়া বীজটা পুঁতেছিল, সেখান থেকে মাটি ফুঁড়ে একটা ছোট্ট চারাগাছ বেরিয়ে এল। তার দুটো পাতা থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিল স্নিগ্ধ আলো। উপত্যকার ঠান্ডা, ভারী বাতাসটা কেটে গিয়ে একটা ফুরফুরে হাওয়া বইতে শুরু করল। দিয়া আর কিংশুক হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে বসে পড়ল। তারা পেরেছে। দিয়া তার নিজের হাতের দিকে তাকাল, চালের গুঁড়োয় সাদা হয়ে আছে। এই প্রথম তার মনে হলো, এই হাত দিয়ে সে শুধু ছবি আঁকতে পারে না, সে পারে একটা মৃতপ্রায় জগৎকে নতুন জীবন দিতে। সে শুধু শিল্পী নয়, সে একজন রক্ষক। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion