অনুরাগের বাঁধন : পর্ব ২
এক অচেনা ছায়া: সন্দেহের বীজ ও বিষাক্ত শ্বাস
সেই ভোরবেলার পর থেকে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হলো। সোনালী রাহুলের প্রতিটি স্পর্শে এক নতুন জগৎ খুঁজে পেত, এক অপার্থিব শান্তি ও উন্মাদনা। রাহুলও সোনালীর মধ্যে নিজের সবকিছু উজাড় করে দিত, তার জীবন যেন সোনালীতে এসে পূর্ণতা পেয়েছিল, তার সত্তা সোনালীতেই খুঁজে পেত আশ্রয়, তার সমস্ত পৃথিবী সোনালীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল, যেন সোনালীই তার কেন্দ্রবিন্দু, তার ধ্রুবতারা, তার সবকিছু। তাদের দেখা হতো প্রায় প্রতিদিনই, কখনো গঙ্গার ঘাটে, কখনো শহরের কোলাহল থেকে দূরে কোনো নির্জন ক্যাফেতে, আবার কখনো রাতের গভীরে লুকিয়ে ছাদের উপর, যেখানে তারা তারাদের নিচে বসে নিজেদের স্বপ্ন বুনত, এক অনন্ত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখত, যা কেবল তাদের ছিল, আর কারো নয়, এক গোপন স্বপ্নের জাল। তাদের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ভালোবাসায় মোড়া, প্রতিটি কথোপকথন ছিল গভীর বোঝাপড়ার এক সেতু, যেন তারা দুজন দুজনার জন্য তৈরি হয়েছিল, একে অপরের পরিপূরক, এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এই নিবিড় সুখের মাঝেও সোনালীর মনে মাঝে মাঝে এক অচেনা অস্বস্তি উঁকি দিত, এক শীতল ছায়া যেন তাদের ভালোবাসার উপর নেমে আসছিল, তাদের নিবিড় বন্ধনে এক ফাটল ধরাতে চাইছিল, তাদের শান্তিকে গ্রাস করতে চাইছিল, তাদের সুখকে বিষাক্ত করে তুলছিল, তাদের জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছিল, তাদের স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছিল।
রাহুল প্রায়ই ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তার কথা বলার ধরনটা বেশ অদ্ভুত, যেন সে কিছু লুকোচ্ছে, যেন তার অন্য এক জীবন আছে যা সোনালীর অজানা, এক অন্ধকার জগত যা সে সযত্নে লুকিয়ে রাখে, যা সোনালীর কাছে এক রহস্য ছিল, এক দুর্ভেদ্য দেয়াল, এক গভীর খাদ। সোনালী যখন কাছাকাছি আসত, সে দ্রুত ফোন কেটে দিত অথবা ফিসফিস করে কথা বলত, তার চোখ অস্থিরভাবে চারদিকে ঘোরাফেরা করত, যেন সে সবসময় সতর্ক থাকত, কোনো অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে, যা তাকে অনুসরণ করছিল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছিল, তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস শুনছিল। সোনালী প্রথম দিকে ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয়নি, ভেবেছিল হয়তো ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার, ব্যবসার গোপনীয়তা, যা সকলেরই থাকে, যা সকলেরই থাকতে পারে, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই, শুধু একটা ভুল বোঝাবুঝি। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ফোন কলগুলো যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করতে শুরু করল তাদের মাঝে, এক বিভেদ যা সোনালীকে ক্রমশ বিচলিত করছিল, তার মনকে কুঁড়ে খাচ্ছিল, তাকে এক অনিশ্চয়তায় ফেলে দিচ্ছিল, তাকে হতাশ করে তুলছিল, তার সব স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছিল, তার শান্তি কেড়ে নিচ্ছিল। একদিন সোনালী দেখতে পেল, রাহুল যখন ফোন দেখছে, তখন তার মুখে একরকমের উদ্বেগ ফুটে উঠছে, যা সে সোনালীর সামনে সযত্নে লুকিয়ে রাখত। রাহুলের চোখ একবার তার দিকে, একবার ফোনের দিকে অস্থিরভাবে ঘোরাফেরা করছিল, যেন সে কিছু গোপন তথ্য লুকিয়ে রাখছিল, যা সোনালীর কাছে পৌঁছাতে চায় না, যা তাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে, তাদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, তাদের ভালোবাসা নষ্ট করতে পারে, তাদের সব কিছু কেড়ে নিতে পারে। সোনালীর মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল, একটি ছোট্ট বীজ যা ধীরে ধীরে একটি বিশাল বৃক্ষে পরিণত হচ্ছিল, তার হৃদয়ে শিকড় গাড়ছিল, তার মনকে আচ্ছন্ন করছিল, তাকে এক গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছিল, তাকে একাকী করে দিচ্ছিল, তার শান্তি কেড়ে নিচ্ছিল। কে এই ব্যক্তি যার সাথে রাহুল এত গোপনীয়তা বজায় রাখে? রাহুলকে সে কতটা জানে? এই প্রশ্নগুলো সোনালীর মনকে নিরন্তর কুরে কুরে খাচ্ছিল, তাকে অস্থির করে তুলছিল, তার ঘুম কেড়ে নিচ্ছিল, তাকে একাকী করে দিচ্ছিল, তাকে হতাশ করে তুলছিল।
একদিন বিকেলে তারা যখন একটি নির্জন পার্কে একটি বেঞ্চে পাশাপাশি বসেছিল, রাহুল হঠাৎ করে বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। তার হাতে সোনালীর হাত ছিল, কিন্তু তার চোখ দুটি দূরে কোথাও নিবদ্ধ ছিল, যেন সে কোনো অদৃশ্য কিছু দেখছে, কোনো ভবিষ্যতের বিপদ যা তার দিকে ধেয়ে আসছে, তাকে গ্রাস করতে চাইছে, তার জীবনকে বিপন্ন করতে চাইছে, তার সব সুখ কেড়ে নিতে চাইছে, তার অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে চাইছে। তার শরীরের ভাষা বদলে গিয়েছিল, এক অচেনা দৃঢ়তা তার মধ্যে লক্ষ্য করছিল সোনালী, যা তাকে আরও ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল, এক অজানা আশঙ্কায় তাকে ভরিয়ে দিচ্ছিল, তার হৃদয়ে এক শীতল স্রোত বইছিল, তার রক্তচাপ কমে গিয়েছিল। “সব ঠিক আছে তো, রাহুল? তোমার মুখটা কেমন শুকনো লাগছে, তুমি যেন কোনো চিন্তায় ডুবে আছো, তোমার মনে শান্তি নেই, তুমি যেন খুব ক্লান্ত, তোমার চোখে ভয়।” সোনালী তার হাত ধরল, তার আঙুলগুলো রাহুলের হাতের উপর আলতো করে চেপে ধরল, তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল, তার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিল, তার ভয় দূর করার চেষ্টা করল, তাকে সাহস যোগাল, তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করল। রাহুল চমকে উঠল, যেন গভীর কোনো ভাবনা থেকে সে হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এসেছে, তার চোখ দুটি মুহূর্তের জন্য আতঙ্কে ভরে উঠল, যা সোনালীকে বিচলিত করে তুলল, তার মনে আরও প্রশ্ন তৈরি করল, তাকে হতাশ করে তুলল। “হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। কেন বলছ?” তার উত্তরটা যেন স্বাভাবিক ছিল না, তার গলায় একরকমের জোর করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা ছিল, যা সোনালীকে আরও সন্দিহান করে তুলল, তার সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে দিল, তাকে আরও গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিল, এক অজানা পথে নিয়ে গেল, তাকে একাকী করে তুলল। সোনালী অনুভব করল, রাহুলের ভেতরে কিছু একটা চলছে, যা সে সোনালীর সাথে ভাগ করে নিতে পারছে না, যা তাকে ভেতরে ভেতরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে, তার জীবনকে অনিশ্চিত করে তুলছিল, তাকে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করছিল। এই অজানা রহস্য তাদের ভালোবাসার উপর এক শীতল আবরণ ফেলছিল, তাদের সুন্দর বন্ধনকে ধীরে ধীরে বিষাক্ত করে তুলছিল, তাদের সম্পর্ককে এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলছিল, এক চরম পরীক্ষার মুখোমুখি করছিল, যা তাদের শেষ করে দিতে পারতো, তাদের সব স্বপ্ন ভেঙে দিতে পারতো।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion