অনুরাগের বাঁধন : পর্ব ৫
মুখোমুখি: উন্মোচিত সত্য ও ভালোবাসার পরীক্ষা
সোনালী পরদিন সকালে আর চুপ করে থাকতে পারল না। তার ভেতরে সব জমে থাকা প্রশ্ন আর ভয় নিয়ে সে রাহুলকে ডায়েরিটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তার চোখ দুটি রাহুলের দিকে স্থির ছিল, যেন সে রাহুলের ভেতরের সব সত্য বের করে আনবে, কোনো কিছু লুকানোর উপায় নেই, তার প্রতিটি ইঙ্গিত ধরতে চাইছিল, তার প্রতিটি রহস্য উন্মোচন করতে চাইছিল, তার জীবনকে বুঝতে চাইছিল। রাহুল প্রথমে অস্বীকার করার চেষ্টা করল, তার চোখে ছিল এক লুকানো আতঙ্ক, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল, যেন সে ধরা পড়ে গেছে, তার অপরাধ ধরা পড়ে গেছে, তার জীবন শেষ হয়ে গেছে, তার সব আশা শেষ হয়ে গেছে। “আমি কিছু জানি না সোনালী, এটা কোনো ভুল হচ্ছে।” তার গলায় ছিল এক অপরাধীর সুর, যা সোনালীর কানে তীক্ষ্ণভাবে বিঁধছিল, তার হৃদয়ে আঘাত করছিল, তার বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছিল। কিন্তু সোনালীর স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল, অস্বীকার করে লাভ নেই, সোনালী তাকে কোনোদিনও ক্ষমা করবে না, তার বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে, তাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে, তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সোনালীর চোখে ছিল অভিমান, রাগ, আর এক গভীর জিজ্ঞাসা, যা রাহুলের আত্মাকে বিদ্ধ করছিল, তাকে আরও অসহায় করে তুলছিল, তাকে চরম অস্থিরতায় ফেলে দিচ্ছিল। “আমাকে বলো, রাহুল। সত্যিটা কি? আমি সব জেনে গেছি। আমাকে মিথ্যা বলবে না। আমি তোমার সবটা জানতে চাই, তোমার জীবনের প্রতিটি কোণ, তোমার অতীত, তোমার অন্ধকার জগত।” সোনালীর গলায় ছিল তীব্র আবেগ আর অভিমান, যা রাহুলের হৃদয়ে আঘাত করছিল, তাকে আরও বেশি দুর্বল করে তুলছিল, তাকে নীরব করে তুলছিল, তাকে বাধ্য করছিল সব বলতে, তার জীবনকে খুলে দিতে।
রাহুল চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তার মাথা নিচু ছিল, যেন সে নিজেকে সোনালীর সামনে অপরাধী মনে করছিল, তার পাপের বোঝা তাকে গ্রাস করছিল, তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল। তার শরীর কাঁপছিল, তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গিয়েছিল, তার ভেতরে এক তীব্র ঝড় বইছিল, যা তাকে ছিন্নভিন্ন করছিল, তার জীবনকে অনিশ্চিত করে তুলছিল, তাকে একাকী করে তুলছিল। তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম, সোনালী। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম তোমাকে হারানোর। আমি তোমার জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চাইনি, আমি তোমাকে বিপদমুক্ত রাখতে চেয়েছিলাম, আমার থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম, তোমাকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছিলাম, তোমাকে হারাতে চাইনি।” তার গলার স্বরে অসহায়তা স্পষ্ট ছিল, যেন সে এক বিশাল বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে, যা তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে, তাকে একাকী করে তুলছে, তাকে একাকী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য করছিল, তার সব আশা শেষ হয়ে গিয়েছিল।
রাহুল বলতে শুরু করল তার অতীত জীবন সম্পর্কে। সে একসময় এমন এক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল, যার নাম ছিল ‘দ্য শ্যাডো উলফস’। তারা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কিছু অন্ধকার দিক নিয়ে কাজ করত, তাদের গোপনীয়তা ফাঁস করে ব্ল্যাকমেইল করত, তাদের ব্যক্তিগত তথ্য জনসমক্ষে নিয়ে আসত, তাদের সম্মান নষ্ট করত, তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলত। তাদের কাজ ছিল তথ্য সংগ্রহ করা, যা দিয়ে ওই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করা যেত, তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা যেত, তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করা যেত, তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করা যেত। রাহুল প্রথমে এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ভালো ভেবেছিল, ভেবেছিল তারা সমাজের অসঙ্গতি দূর করতে সাহায্য করবে, দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি দেবে, সমাজকে পরিষ্করণ করবে, এক নতুন সমাজ গড়বে, যেখানে কোনো দুর্নীতি থাকবে না, যেখানে সবাই সৎ থাকবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, এটা ছিল শুধু ক্ষমতার খেলা, এক ভয়ংকর দুষ্টচক্র, যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সবকিছু করতে পারত, যারা কোনো নীতি নৈতিকতা মানত না, যাদের কাছে মানুষের জীবন ছিল তুচ্ছ, যাদের কাছে মানুষের আবেগ ছিল অর্থহীন, যারা শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখত। যখন সে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল, তাদের ভয়ংকর পদ্ধতিগুলো দেখে, তখন থেকেই বিপদ শুরু হলো। সেই সংগঠনের সদস্যরা তাকে হুমকি দিতে শুরু করল, তার জীবনকে বিষিয়ে তুলল, তার প্রতিটি পদক্ষেপের উপর নজর রাখতে শুরু করল, তাকে এক বন্দী জীবনে ঠেলে দিল, তাকে একাকী করে তুলল, তাকে নিঃশেষ করে দিতে চাইছিল। তারা রাহুলের প্রতিটি দুর্বলতা জানত, তার পরিবারের সদস্যদের খবর রাখত, তার ভালোবাসার মানুষের উপর নজর রাখত, তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করত। সেই কারণেই সে স্থান পরিবর্তন করে কলকাতা এসেছিল, এক নতুন জীবন শুরু করার আশায়, সবকিছু পেছনে ফেলে, তার অতীতকে ভুলে গিয়ে, সোনালীর সাথে এক নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিল, এক নতুন আশা নিয়ে বেঁচে ছিল, এক নতুন জীবনের শুরু করতে চেয়েছিল।
“আমি ভেবেছিলাম, আমি সব কিছু পেছনে ফেলে এসেছি,” রাহুল বলল, তার চোখে হতাশা, “কিন্তু মনে হচ্ছে ওরা আমাকে খুঁজে পেয়েছে। ওরা আমাকে কোনোদিনই ছেড়ে দেবে না, ওরা আমার পিছু ছাড়বে না, আমার জীবনকে নরক করে তুলবে, আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দেবে, আমাকে ধ্বংস করে দেবে।” রাহুলের প্রতিটি কথা সোনালীর বুকে ছুরি চালাচ্ছিল। তার প্রিয় মানুষটি এমন এক ভয়ংকর অতীত নিয়ে বেঁচে আছে, আর সে কিছুই জানে না। এই মানুষটাকে সে কতটা ভালোবাসে, সেই ভালোবাসার উপর কি এই বিপদের ছায়া পড়বে? সোনালী বুঝতে পারছিল না, তার জীবন কোন পথে যাচ্ছে, তার ভবিষ্যৎ কি হবে, সে কি পারবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে, সে কি পারবে রাহুলকে বাঁচাতে। এই অপ্রত্যাশিত সত্য তার জীবনকে এক নতুন মোড়ে নিয়ে এসেছিল, এক কঠিন সিদ্ধান্ত তার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিল, এক কঠিন পথ তাকে বেছে নিতে বাধ্য করছিল, যা তার জীবন বদলে দেবে, যা তাদের সম্পর্ককে এক নতুন দিকে নিয়ে যাবে।
সোনালী নিজেকে সামলে নিল, তার চোখের জল মুছে ফেলল। এই মুহূর্তে রাহুলকে তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তার ভয় ছিল, তার মন আতঙ্কে ভরে গিয়েছিল, কিন্তু তার ভালোবাসার শক্তি সেই ভয়কে ছাপিয়ে গেল, তার হৃদয় এক নতুন সংকল্পে ভরে উঠল, এক অদম্য সাহস তার মধ্যে জেগে উঠল, সে যেন এক যোদ্ধা হয়ে উঠল, রাহুলকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত, তাকে বাঁচাতে প্রস্তুত। “আমরা একসাথে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করব, রাহুল,” সোনালী দৃঢ়ভাবে বলল, তার কণ্ঠস্বর ছিল আবেগে ভারাক্রান্ত, কিন্তু দৃঢ়তায় অটল, যেন তার প্রতিটি শব্দে ছিল অসীম শক্তি, যা রাহুলকে সাহস যোগাচ্ছিল, তাকে নতুন করে বাঁচতে শেখাচ্ছিল, তাকে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করছিল, তাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। “আমি তোমার পাশে আছি। আমরা একসাথে এই ঝড় মোকাবেলা করব। আমি তোমাকে একা ছেড়ে দেবো না, কোনোদিনও না, তোমার সাথে আছি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, আমাদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত।”
রাহুলের চোখে জল এসে গেল। সে সোনালীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সেই আলিঙ্গনে ছিল ভালোবাসা, ভয়, আর এক অজানা ভবিষ্যতের প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। তারা জানত, তাদের সামনে এক কঠিন পথ, এক দীর্ঘ সংগ্রাম, কিন্তু তারা একা নয়, তারা একে অপরের সাথে আছে, এক অটুট বন্ধনে, যা কোনোদিনও ভাঙবে না, যা তাদের চিরদিনের জন্য এক করে দেবে, যা তাদের শক্তি জোগাবে।
চলবে….
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion