Episode 3503 words2 views

তৃতীয় অধ্যায়: অদৃশ্য অনুসরণ

পরের কয়েকটা দিন রাতুল ক্যামেরা ছুঁলো না। রাতে সে আর বেরোয় না। সন্ধে হলেই দরজা-জানলা বন্ধ করে আলো জ্বেলে বসে থাকে। ঘুম প্রায় হয় না। যখনই চোখ বন্ধ করে, সে ওই মসৃণ, অন্ধকার মুখটা দেখতে পায়। সে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও গেলো। ডাক্তার সব শুনে তাকে অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার (Anxiety Disorder) এবং প্যারানইয়া (Paranoia)-র ওষুধ দিলেন। বললেন, অতিরিক্ত রাত জাগা, একা থাকা আর কফির প্রভাবেই এটা হচ্ছে। রাতুল ওষুধগুলো খেলো। কিন্তু ভয়টা শুধু মনের মধ্যে ছিল না। সেদিন দুপুরে সে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ তার মনে হলো, উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের বারান্দার কোণে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছায়া। সে ভালো করে তাকাতেই সেটা মিলিয়ে গেলো। আয়নায় মুখ ধুতে গিয়ে তার মনে হলো, তার ঠিক পিছনে, দরজার কাছে, একটা ছায়া সরে গেলো। তার ফ্ল্যাটের জিনিসপত্রগুলোও কেমন অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করলো। টেবিলের ওপর রাখা লেন্সের ক্যাপটা নিজে থেকেই গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলো। রান্নাঘরের বন্ধ কল থেকে মাঝরাতে টুপ টুপ করে জল পড়তে শুরু করলো। রাতুল বুঝতে পারছিল, সে পাগল হয়ে যাচ্ছে না। এসডি কার্ড ভেঙে ফেলায় কোনো লাভ হয়নি। ওটা এসে গেছে। ওটা তার ফ্ল্যাটে, তার সাথেই আছে। কিন্তু কেন? সে তো শুধু একটা ছবি তুলেছিল! এক সপ্তাহ পর রাতুল আর থাকতে পারলো না। ভয়টাকে জয় করার একটাই উপায়—ভয়ের মুখোমুখি হওয়া। সে ঠিক করলো, সে আবার ছবি তুলবে। সে জানতে চায়, ওটা এখনও আছে কি না। তার অন্য এসডি কার্ড ছিল। সে সেটা ক্যামেরায় ভরলো। রাত দুপুরে নয়, ভর সন্ধেবেলা সে ক্যামেরা নিয়ে বেরলো। গন্তব্য—প্রিন্সেপ ঘাট। সেখানে অনেক লোক থাকে। অত লোকের মাঝে নিশ্চয়ই কিছু হবে না। ঘাটের ধারে বসে সে ক্যামেরা অন করলো। হাত কাঁপছিল। সে গঙ্গার দিকে ক্যামেরা তাক করলো। ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখলো। গঙ্গার জল, দূরে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর আলো, নৌকোগুলো—সব স্বাভাবিক। কোনো ছায়া নেই। রাতুল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক, তাহলে বোধহয় দুঃস্বপ্নটা কেটে গেছে। হয়তো সেদিন সে অতিরিক্ত ক্লান্ত ছিল। ডাক্তারের ওষুধেই কাজ হয়েছে। সে খুশি মনে বেশ কয়েকটা ছবি তুললো। তারপর সে ক্যামেরাটা ঘোরালো নিজের দিকে, যেখানে লোকজন বসে আড্ডা দিচ্ছিল। ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখতেই তার রক্ত জল হয়ে গেলো। লোকজনের ভিড়ের মধ্যেই ওটা দাঁড়িয়ে আছে। যে বেঞ্চিটায় একটা পরিবার বসে আইসক্রিম খাচ্ছিল, ঠিক তাদের পিছনে। কেউ ওটাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু রাতুলের ক্যামেরা ওটাকে ঠিক ধরে ফেলছে। এবং ওটা আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট। এখন সে বুঝতে পারছে, ওটা একটা মেয়ের ছায়া। পরনে যেন একটা পুরনো ধাঁচের শাড়ি। রাতুল ক্যামেরা নামিয়ে ফেললো। সে ভিড়ের দিকে তাকালো। খালি চোখে কিচ্ছু নেই। শুধু মানুষজন, হাসি, কথা। সে আবার ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখলো। ছায়ামূর্তিটা এগিয়ে এসেছে। এখন সেটা ঠিক তার সামনে, পাঁচ ফুট দূরে, গঙ্গার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোজা তার দিকে "তাকিয়ে"। রাতুল আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। ক্যামেরাটা ব্যাগে ভরে সে দৌড় দিলো। সে শুনতে পাচ্ছিল, তার ক্যামেরা ব্যাগের ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত হিসহিস শব্দ আসছে। ফ্ল্যাটে ফিরে সে ঠিক করলো, এই ক্যামেরাই সব নষ্টের গোড়া। এই হাই-টেক সেন্সর, এই ইলেকট্রনিক ভিউফাইন্ডার—এটাই কোনোভাবে সেই অভিশাপটাকে দেখে ফেলেছে। সে ক্যামেরাটাকে ব্যাগে ভরে আলমারির সবথেকে উপরের তাকে তুলে রাখলো। ঠিক করলো, ওটা বেচে দেবে। কিন্তু সেদিন রাতেই ঘটনাটা ঘটলো। রাতুলের ঘুম ভেঙে গেলো একটা খটাস শব্দে। সে দেখলো, আলমারির দরজাটা খোলা। আর তার ক্যামেরা ব্যাগটা... সেটা উপরের তাক থেকে নেমে এসে তার বিছানার ঠিক পাশে মেঝেতে পড়ে আছে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion