রাতুল বুঝতে পারছিল, ক্যামেরা ফেলে দিয়ে বা বেঁচে দিয়ে লাভ হবে না। এই ছায়াটা তাকে বা তার ক্যামেরাকে ছাড়বে না। তাকে জানতে হবে, এসপ্ল্যানেডের ওই গলিতে কী হয়েছিল। ওই ছায়ামূর্তিটা কে?
পরদিন সকালেই সে আবার ওই গলিতে গেলো। দিনের আলোয় গলিটাকে আরও বেশি জরাজীর্ণ দেখাচ্ছিল। সে সেই ভাঙা খিলানটার কাছে গেলো। দেওয়ালে শ্যাওলা, বট-অশ্বত্থের চারা।
গলির মুখেই একটা চায়ের দোকান। সে সেখানে গিয়ে এক ভাঁড় চা নিলো। দোকানদার এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, অনেকদিন ধরে এখানে দোকান চালাচ্ছেন।
"দাদু, এই গলিটার ভেতরে কী আছে?" রাতুল জিজ্ঞেস করলো।
দোকানদার তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালো। "কেন বাবু? ভেতরে যাবেন নাকি? না যাওয়াই ভালো। ওটা পোড়ো গুদাম। এককালে এক সাহেবের স্টুডিয়ো ছিল।"
"স্টুডিয়ো? ফটোগ্রাফির স্টুডিয়ো?" রাতুলের কৌতূহল বাড়লো।
"হ্যাঁ বাবু। তবে যেমন তেমন স্টুডিয়ো নয়। সে বড় সাঙ্ঘাতিক জায়গা।" বৃদ্ধ একটা টুল টেনে বসলো। "আমার বাবার কাছে শোনা। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগে, কালীপদ সাহা বলে এক লোক ছিল। নামকরা ফটোগ্রাফার। এই গলিতে তার স্টুডিয়ো ছিল। 'ছায়াপথ স্টুডিয়ো'।"
রাতুলের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠলো। "ছায়াপথ?"
"হ্যাঁ। লোকটা নাকি শুধু জ্যান্ত মানুষের ছবি তুলতো না। সে সাহেবসুবোদের বাড়ির মরা মানুষেরও ছবি তুলতো। কী সব ভিক্টোরিয়ান না কী যেন বলে।"
"পোস্ট-মর্টেম ফটোগ্রাফি," রাতুল ফিসফিস করলো।
"ওই হবে। কিন্তু লোকটার আসল নেশা ছিল অন্য। সে নাকি তন্ত্রসাধনা করতো। তার বিশ্বাস ছিল, মানুষের মৃত্যুর ঠিক পর মূহুর্তে তার 'ছায়া' বা আত্মাকে নাকি ক্যামেরায় ধরা যায়। সে এই গুদোমঘরে একটা ডার্করুম বানিয়েছিল। সেখানে সে ছবি তোলা আর পুজো-আচ্চা—সব একসাথেই করতো।"
বৃদ্ধ একটু থামলো। "লোকটার শেষটা ভালো হয়নি। তার স্টুডিয়োতে অমিশা বলে একটি মেয়ে মডেল হিসেবে কাজ করতো। খুব সুন্দরী ছিল। কালীপদর নজর ছিল মেয়েটার ওপর। কিন্তু মেয়েটা পাত্তা দেয়নি। একদিন রাতে স্টুডিয়োতে কী নিয়ে যেন ঝামেলা হয়। তারপর থেকে মেয়েটাকেও আর দেখা যায়নি, আর কালীপদকেও না।"
"পুলিশ?"
"আরে বাবু, তখন দাঙ্গার সময়। '৪৬ সাল। কে কার খোঁজ রাখে! লোকে বলে, কালীপদ ওই মেয়েটাকে বলি দিয়ে তার আত্মাকে ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তন্ত্রের কোনো ভুলে আত্মাটা ওই ক্যামেরা বা ওই স্টুডিয়োতেই আটকে পড়ে। আর কালীপদর কী হলো, কেউ জানে না। ওই গুদামের ভেতর থেকেই নাকি তার শেষ চিৎকার শোনা গিয়েছিল।"
বৃদ্ধ চায়ের ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে বললো, "তারপর থেকে ওই গলিটা অশুভ। সন্ধের পর ওদিকে কেউ যায় না। লোকে বলে, ওই মেয়েটার ছায়া—অমিশা—এখনও ওই খিলানের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুক্তির অপেক্ষায়।"
রাতুল সবটা বুঝতে পারলো। তার হাই-এন্ড মিররলেস ক্যামেরা, যার সেন্সর সাধারণ মানুষের চোখের চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল, সে কোনোভাবে ওই আটকে থাকা আত্মাকে, ওই 'ছায়া'কে আবার দেখতে পেয়েছে। ছবি তুলে সে ওই ছায়াকে জাগিয়ে তুলেছে।
আর এখন সেই ছায়া—অমিশা—তার ক্যামেরাকেই তার জেলখানা ভাবছে। অথবা, সে রাতুলের মাধ্যমে কিছু একটা বলতে চায়।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion