Episode 5447 words1 views

পঞ্চম অধ্যায়: প্রথম ক্লিক

রাতুল যখন ফ্ল্যাটে ফিরলো, তখন সন্ধে। সে দরজা খুলতেই একটা হিম ঠান্ডা হাওয়া তাকে ধাক্কা দিলো। ঘরের সব আলো নেভানো। সে আলো জ্বালতে গেলো। জ্বললো না। লোডশেডিং। বাইরে ঘনঘন বাজ পড়ছে। ঝড় উঠবে। রাতুল টর্চ জ্বেলে দেখলো, তার আলমারিটা খোলা। ক্যামেরা ব্যাগটা মাঝঘরে পড়ে আছে। আর তার ডিজিটাল ক্যামেরাটা... সেটা ব্যাগের বাইরে, তার পড়ার টেবিলে রাখা। যেন কেউ ওটাকে সযত্নে সাজিয়ে রেখেছে। রাতুল বুঝতে পারলো, আজ রাতেই যা হওয়ার হবে। ছায়াটা আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। সে টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলো। ক্যামেরাটা হাতে নিলো। অদ্ভুত ঠান্ডা। "কী চাও তুমি?" রাতুল শূন্যে প্রশ্ন করলো। "মুক্তি?" কোনো উত্তর এলো না। কিন্তু ঘরের তাপমাত্রা যেন আরও কমে গেলো। রাতুল স্পষ্ট শুনতে পেলো, তার কানের পাশে কেউ ফিসফিস করে কাঁদছে। একটা মেয়ের কান্নার শব্দ। হঠাৎ তার চোখ পড়লো তার পুরনো বুকশেলফটার দিকে। সেখানে ধুলোর মধ্যে পড়ে আছে একটা জিনিস, যা সে বহুদিন ব্যবহার করেনি। তার বাবার পুরনো ইয়াশিকা (Yashica) ফিল্ম ক্যামেরা। একটা সম্পূর্ণ অ্যানালগ এসএলআর (SLR) ক্যামেরা। রাতুল কারণটা ঠিক জানে না, কিন্তু তার মন বললো, এটাই করতে হবে। কালীপদ সাহা যখন ছবি তুলতো, তখন ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না। সে ফিল্মেই ছবি তুলতো। হয়তো এই ছায়াকে ডিজিটাল সেন্সর নয়, অ্যানালগ ফিল্মেই ধরতে হবে। সে ডিজিটাল ক্যামেরাটা টেবিলেই রাখলো। অ্যানালগ ক্যামেরাটা হাতে নিলো। ওটার ভেতরে একটা সাদা-কালো ফিল্মের রোল (Kodak T-Max 400) অর্ধেক ভরা ছিল। সে কাঁপা হাতে ফিল্মটা রিওয়াইন্ড করে ঠিক করলো। ফ্ল্যাশগানটা (Flashgun) খুঁজে বের করে ক্যামেরার মাথায় লাগালো। "যদি তুমি মুক্তি চাও," রাতুল ফিসফিস করে বললো, "তাহলে তোমায় ধরা দিতে হবে। শেষবারের মতো।" সে ডিজিটাল ক্যামেরাটার দিকে তাকালো। দেখলো, ওটার ভিউফাইন্ডারটা নিজে থেকেই জ্বলছে-নিভছে। যেন একটা হৃদস্পন্দন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, ঘরের কোণের জমাট বাঁধা অন্ধকারটা নড়ে উঠলো। ওটা এগিয়ে আসছে। অমিশার ছায়া। এখন আর সেটা আবছা নয়। রাতুল খালি চোখেই ওটাকে দেখতে পাচ্ছিল। একটা পূর্ণাঙ্গ অবয়ব, কিন্তু তার শরীরটা যেন তারার বদলে অন্ধকার দিয়ে তৈরি। তার মুখ নেই, চোখ নেই, শুধু একটা গভীর শূন্যতা। ছায়াটা ডিজিটাল ক্যামেরাটার ওপর ঝুঁকে পড়লো। যেন ওটাকে শুষে নিতে চাইছে। রাতুল ঠিক এই মুহূর্তটার অপেক্ষাতেই ছিল। সে তার বাবার অ্যানালগ ক্যামেরাটা তুললো। ফোকাস রিং-টা আন্দাজে ঘোরালো। "অমিশা!" সে চিৎকার করে উঠলো। ছায়ামূর্তিটা তার দিকে ফিরলো। সেই মুখহীন শূন্যতা সোজা তাকালো তার দিকে। রাতুল শাটার টিপে দিলো। ক্লিক! অ্যানালগ ক্যামেরার যান্ত্রিক শাটারের শব্দটা যেন বোমার মতো ফাটলো। তার সাথে সাথেই ফ্ল্যাশগানের তীব্র সাদা আলোয় ঘরটা ভরে গেলো। এক মুহূর্তের জন্য রাতুল দেখলো। ওটা ছায়া নয়। একটা শাড়ি পরা কঙ্কাল, তার দুটো চোখের কোটরে শুধু আগুন জ্বলছে। তারপরই একটা কান ফাটানো চিৎকার। ছায়াটা যেন আলোর তাপে বাষ্প হয়ে গেলো। সব নিস্তব্ধ। ঘরের আলোটা দপ করে জ্বলে উঠলো। লোডশেডিং শেষ। রাতুল হাঁপাচ্ছিল। তার অ্যানালগ ক্যামেরাটা তখনও তার হাতে। আর তার ডিজিটাল ক্যামেরাটা... সেটা টেবিলের ওপর পড়ে আছে। লেন্সটা ফেটে চৌচির। বডিটা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ওটার সেন্সরটা তীব্র আলো বা কোনো এক অজানা শক্তিতে পুরোপুরি জ্বলে গেছে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion