সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেটা একটা ছোট, চৌকো ঘর। চারদিকে মাটির দেওয়াল। বাতাস নেই, কিন্তু দমবন্ধ করা ঠান্ডা। অর্কর মনে হলো সে একটা কবরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। বাতাস এত ভারী যে নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন।
ঘরের এক কোণে একটা ছোট কাঠের সিন্দুক। ধুলোয় এমনভাবে ঢাকা যে ওটার আসল রঙ বোঝা যাচ্ছে না। অর্ক সেটার দিকে এগিয়ে গেলো। সিন্দুকটা তালাবন্ধ নয়, একটা পিতলের ছিটকিনি দিয়ে আটকানো।
কাঁপা হাতে সে ছিটকিনিটা খুললো। ভেতরে লাল শালুতে জড়ানো একটা জিনিস। শালুটা এখনও উজ্জ্বল, যেন কালকেই পাতা হয়েছে।
অর্ক শালুটা সরালো। একটা তালপাতার পুঁথি। হলদে হয়ে যাওয়া পাতাগুলো একটা তামার তার দিয়ে বাঁধা। ওপরের পাতায় কালির অক্ষরে লেখা— "দেবীর ব্রতকথা"।
অর্ক পুঁথিটা হাতে তুলে নিলো। তার সাথে আরও কিছু জিনিস ছিল। একটা ছোট মখমলের থলি। সেটার ভেতরে একটা অদ্ভুত দর্শন পাথরের লকেট, সেই মিনচক্রের চিহ্ন আঁকা। আর একটা ছোট, জং ধরা ছোরা, তার বাঁটটা হাতির দাঁতের।
অর্ক পুঁথিটা আর থলিটা সাবধানে ব্যাগে ভরলো। ছোরাটা সে ওখানেই রেখে দিলো। তারপর ওপরে উঠে এলো। স্ল্যাবটা কোনোমতে আবার জায়গা মতো বসিয়ে দিলো। নিজের ঘরে ফিরে এসে সে দরজা বন্ধ করলো। তার বুক ধড়ফড় করছে।
সে পুঁথিটা খুললো। ভাষাটা প্রাচীন বাংলা, পদ্যের আকারে লেখা। অর্ক প্রথম কয়েকটা পাতা ওল্টালো। সাধারণ শ্লোক, দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা।
"এতো সামান্য ব্রতকথা," সে বিড়বিড় করলো। "এর জন্য এত গোপনীয়তা? এত লুকোচুরি?"
সে পাতা ওল্টাতে লাগলো। পুঁথিটার মাঝখানের কয়েকটা পাতা অন্যরকম। সেখানে পদ্যের বদলে সাংকেতিক চিহ্ন, কিছু অদ্ভুত জ্যামিতিক নকশা আর সংখ্যা। যেন কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং-এর খসড়া।
আর একটা পাতার ভাঁজে সে একটা ছোট তুলোট কাগজ পেলো। তাতে কাঁপাকাঁপা হাতে কালচে হয়ে যাওয়া কালিতে লেখা কয়েকটা লাইন:
“বিশ্বাসঘাতক! সে আমার রক্তে তার লোভের তর্পণ করলো। কিন্তু দেবীর রত্ন সে পাবে না। আমি তা লুকিয়ে রাখলাম। যেখানে ছায়া আর জল মিলিত হয়, যেখানে সূর্যের প্রথম আলো ভূমি স্পর্শ করে। আমার আত্মা এই পুঁথিকে পাহারা দেবে, যতক্ষণ না আমার বংশের কেউ এসে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে।”
নীচে একটা সই। ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী।
অর্কর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেলো। ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন তার প্রপিতামহের বাবা। অর্কর ঠাকুরদার কাছে শোনা, তিনি নাকি খুব অল্প বয়সে নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন। লোকে বলতো, তিনি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলেন।
"নিখোঁজ নয়... খুন," অর্কর গলা শুকিয়ে এলো। "বিশ্বাসঘাতক... রক্তে তর্পণ...।"
এই গুপ্তধন তাহলে কোনো সোনাদানা নয়, এটা একটা খুনের রহস্যের সমাধান। আর এই বাড়িটাই সেই রহস্যের কেন্দ্র।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion