পরের কয়েকটা দিন অর্ক তার আর্কিটেকচারের কাজ ভুলে গেলো। সে ডুবে গেলো সেই পুঁথির মধ্যে। রাত জেগে সে ওই সাংকেতিক লেখাগুলোর পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু ওগুলো কোনো ভাষা নয়, স্রেফ চিহ্ন। তার লজিক্যাল মন এই ধাঁধার কোনো কূলকিনারা পেলো না।
তার ব্যবহারেও পরিবর্তন আসছিল। সে এখন আরও বেশি চুপচাপ, খিটখিটে। সামান্য শব্দেই চমকে ওঠে। তার বারবার মনে হয়, সে যখন পুঁথিটা নিয়ে বসে, তখন জানলার বাইরে কে যেন দাঁড়িয়ে তাকে দেখে।
শম্ভু জ্যাঠা সেদিন সকালে চা দিতে এসে বললেন, "বাবু, আপনাকে কেমন চিন্তিত দেখাচ্ছে। রাতের ঘুম হচ্ছে না? শরীর ভালো আছে?"
"হ্যাঁ, জ্যাঠা। ভালো," অর্ক ইতস্তত করে বললো। "আচ্ছা, আপনি ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী নামে কাউকে চিনতেন?"
শম্ভু জ্যাঠার হাতটা এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলো। চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, "পুরনো কথা, বাবু। তিনি আপনার ঠাকুরদার বাবা ছিলেন। আমি দেখিনি, আমার বাবার কাছে শোনা। খুব তেজস্বী পুরুষ ছিলেন। আবার খুব ধার্মিকও। লোকে বলে, তিনি নাকি দেবীর রোষে পড়েছিলেন। তাই অকালে চলে গেলেন।"
"রোষ? কেন? কী করেছিলেন তিনি?"
"তিনি নাকি ঠাকুরঘরের মূর্তিটা সরাতে চেয়েছিলেন। এই বংশের পতন তো তারপরই শুরু হলো। দেবীর অভিশাপ।"
অর্ক বুঝতে পারলো, শম্ভু জ্যাঠা কিছু একটা লুকোচ্ছেন। হয়তো সবটা জানেন না, শুধু লোকমুখে শোনা কথাই বিশ্বাস করেন। "অভিশাপ" শব্দটা এখানে সবাই বড় বেশি সহজে ব্যবহার করে।
সেদিন বিকেলে সে দেবীতীর্থ বাজার এলাকায় গেলো। একটা পুরনো বইয়ের দোকান, 'জ্ঞানভারতী'। মালিক এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি।
"নমস্কার। আমি অর্ক মিত্র। ওই রায়চৌধুরী বাড়িটা সংস্কার করতে এসেছি।"
ভদ্রলোক বই থেকে মুখ তুলে চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন। "রায়চৌধুরীদের বংশধর? বসুন, বসুন। আমি অনিমেষ সান্যাল। রিটায়ার্ড প্রফেসর। ইতিহাস আমার শখ, আর এই বইয়ের দোকানটা আমার নেশা।"
"আপনার কাছে দেবীতীর্থের কোনো পুরনো ইতিহাস বা ওই বাড়ির বিষয়ে কোনো বই পাওয়া যাবে?"
অনিমেষবাবু হাসলেন। "বইয়ে সব কথা লেখা থাকে না, হে ছোকরা। ওই বাড়ি একটা আস্ত রহস্য। লোকে বলে, ওখানে গুপ্তধন আছে। আবার কেউ বলে, অভিশাপ আছে। সব গুলিয়ে গেছে।"
অর্ক ঝুঁকিটা নিলো। সে ব্যাগ থেকে পুঁথিটা বের করলো। "আমি এটা বাড়ির ঠাকুরঘর থেকে পেয়েছি।"
অনিমেষ সান্যালের চোখ চশমার কাঁচের আড়ালে জ্বলে উঠলো। তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে পুঁথিটা নিলেন। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো।
"এ তো সর্বনেশে জিনিস!" তিনি ফিসফিস করে বললেন। "এ তো সাধারণ ব্রতকথা নয়। এ হলো 'নাগবর্মী' সংকেত। তিব্বতী আর প্রাচীন বাংলার প্রাকৃত ভাষার মিশ্রণে তৈরি এক গুপ্ত লিপি। আমাদের এই অঞ্চলে এককালে তান্ত্রিক বৌদ্ধদের প্রভাব ছিল। ভুটান আর তিব্বতের সাথে বাণিজ্যের পথে এই দেবীতীর্থ ছিল একটা বড় কেন্দ্র। তাদেরই ব্যবহৃত সংকেত।"
"আপনি এর মানে উদ্ধার করতে পারবেন?"
"পারবো," অনিমেষবাবু বললেন। "তবে সময় লাগবে। এর জন্য আমার কিছু পুরনো খাতা ঘাঁটতে হবে। কিন্তু একটা কথা। এই পুঁথি পাওয়ার কথা যেন আর কেউ না জানে। বিশেষ করে বীরেন্দ্রনারায়ণ।"
"বীরেন্দ্রনারায়ণ কে?"
"বীরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। পাশের মেঘডুম্বুর চা বাগানের মালিক। ক্ষমতাবান লোক। তার পূর্বপুরুষরা এককালে এই রায়চৌধুরী বাড়ির দেওয়ান ছিলেন। শোনা যায়, ঈশ্বরচন্দ্রের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তাদেরও হাত ছিল। ওই দেওয়ান—বীরভদ্র চৌধুরী—ঈশ্বরচন্দ্রের অন্তর্ধানের পরই রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠেন এবং এই চা বাগান কেনেন।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion