অর্ক যখন অনিমেষবাবুর দোকান থেকে বেরোলো, তখন প্রায় সন্ধে। বাজারটা দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। একটা হিমেল হাওয়া বইছে। কুয়াশা নামতে শুরু করেছে।
অর্ক বাড়ি ফেরার জন্য একটা রিকশা নিলো। রিকশাটা মূল রাস্তা ছেড়ে একটা শর্টকাট ধরলো, চা বাগানের ভেতরের রাস্তা দিয়ে।
চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু রিকশার টুংটাং শব্দ আর ঝিঁঝিঁর ডাক। চা গাছের সারিগুলো অন্ধকারে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। হঠাৎ অর্কর মনে হলো, কেউ যেন তাদের অনুসরণ করছে। সে পেছনে তাকালো। কুয়াশার মধ্যে দুটো ছায়ামূর্তি।
"একটু জোরে চালান," অর্ক রিকশাওয়ালাকে বললো।
রিকশাওয়ালা গতি বাড়ালো। কিন্তু ছায়ামূর্তি দুটোও যেন গতি বাড়ালো। তারা দৌড়ে আসছে।
"দাঁড়ান!" একটা কর্কশ গলার স্বর ভেসে এলো।
রিকশাওয়ালা ভয়ে রিকশা থামিয়ে দিলো। দুজন লোক, মুখ মাফলারে ঢাকা, রিকশাটা ঘিরে দাঁড়ালো।
"কাছে কী আছে, সব বের কর," একজন গর্জে উঠলো।
"আমার কাছে শুধু মানিব্যাগ আর মোবাইল আছে," অর্ক শান্ত থাকার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার গলা কাঁপছিল।
"ওসব চাই না। ওই পুঁথিটা দে," অন্যজন বললো। তার হাতে একটা ভোজালি চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠলো।
অর্ক চমকে উঠলো। এরা পুঁথিটার কথা জানলো কী করে? সে অনিমেষবাবুর দোকান থেকে বেরোনোর পর এরা তার পিছু নিয়েছে। তার মানে, অনিমেষবাবুর দোকানেও ওদের লোক ছিল।
"কিসের পুঁথি? আমি জানি না," অর্ক বললো।
লোকটা একটা ছুরি বের করলো। "ভালো চাস তো দিয়ে দে। ওটা তোর জিনিস নয়। ওটা চৌধুরীবাবুর।"
অর্ক বুঝতে পারলো, বীরেন্দ্রনারায়ণের লোক এরা। সে ব্যাগটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। "পারবো না।"
লোকটা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। অর্ক ব্যাগটা দিয়ে আঘাতটা আটকাতে গেলো। ধস্তাধস্তি শুরু হলো। অর্ক চিৎকার করে উঠলো।
ঠিক তখনই, অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটা লাঠি সপাটে এসে লোকটার হাতে পড়লো। ভোজালিটা ছিটকে গেলো।
"হারামজাদার দল! বাবুর গায়ে হাত!"
শম্ভু জ্যাঠা! একটা মোটা লাঠি হাতে তিনি দাঁড়িয়ে কাঁপছেন। তার পেছনে আরও দুজন লোক, সম্ভবত বাগানের মালি।
"শম্ভুদা! তুমি!" একজন লোক চিনতে পেরে বললো।
"চিনতে পারছিস? তবে রে!" শম্ভু জ্যাঠা আবার লাঠি তুললেন।
ছায়ামূর্তি দুটো আর দাঁড়ালো না। কুয়াশার মধ্যে দৌড়ে চা বাগানের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।
"আপনি ঠিক আছেন, বাবু?" শম্ভু জ্যাঠা হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন।
"হ্যাঁ। আপনি... আপনি কী করে?" অর্কর বুক তখনও ধড়ফড় করছে।
"আমি বাজার থেকে ফিরছিলাম। আপনাকে রিকশায় উঠতে দেখলাম। তারপর দেখলাম, ওই শয়তান দুটোও আপনার পিছু নিলো। আমার সন্দেহ হওয়াতে আমি বাগানের লোকদের ডেকে এই শর্টকাট দিয়ে চলে আসি," শম্ভু জ্যাঠা বললেন। "এরা বীরেন্দ্রনারায়ণের লোক। আপনি নিশ্চয়ই এমন কিছু পেয়েছেন, যা ও চায়।"
অর্ক আর লুকোলো না। বাড়ি ফিরে সে শম্ভু জ্যাঠাকে সব খুলে বললো। পুঁথি, ঈশ্বরচন্দ্রের চিঠি, সব।
সব শুনে শম্ভু জ্যাঠা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। "আমি জানতাম। আমার বাবা বলতেন, এই বাড়ির পাপ একদিন সামনে আসবেই। বাবু, আপনি খুব সাবধানে থাকবেন। বীরেন্দ্রনারায়ণ হলো বিষাক্ত সাপ। তার বাপ-ঠাকুরদারাও তাই ছিল।" শম্ভু জ্যাঠার চোখ দুটো জ্বলছিল। "আমার বাবা এই রায়চৌধুরী বাড়ির নুন খেয়েছেন। আমিও খেয়েছি। আপনার জ্যাঠামশাই আমায় ছেলের মতো দেখতেন। আপনাকে আমি কিচ্ছুটি হতে দেবো না।"
সেই রাত থেকে, শম্ভু জ্যাঠা আর বাড়ি গেলেন না। তিনি বাইরেমহলের অন্য ঘরটায় থাকতে শুরু করলেন।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion