পরদিন ভোরবেলা। অর্ক, শম্ভু জ্যাঠা আর অনিমেষবাবু দিঘিটার কাছে এলেন। দিঘিটা শুকিয়ে গেছে। পাঁক আর কচুরিপানায় ভরা। একটা দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।
"নকশা অনুযায়ী," অর্ক বললো, "সুড়ঙ্গের মুখটা দিঘির ঠিক মাঝখানে হওয়ার কথা। একটা পাথরের চাঁইয়ের নিচে।"
তারা তিনজন পাঁকের মধ্যে নামলো। শম্ভু জ্যাঠা একটা শাবল এনেছিলেন। দিঘির মাঝখানে সত্যিই একটা বড় পাথর।
"বীরেন্দ্রনারায়ণের লোক আসছে, বাবু!" শম্ভু জ্যাঠা চেঁচিয়ে উঠলেন।
বাগানবাড়ির দিক থেকে দশ-বারোজন লোক লাঠিসোঁটা হাতে ছুটে আসছে।
"তাড়াতাড়ি!" অর্ক বললো।
দুজনে মিলে শাবল দিয়ে পাথরটা সরালো। নিচে একটা ইটের সুড়ঙ্গের মুখ।
"আপনারা ভেতরে যান, বাবু! আমি এদের আটকাচ্ছি!" শম্ভু জ্যাঠা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
"না, জ্যাঠা! আপনিও আসুন!"
"আমার বংশ এই পরিবারের নুন খেয়েছে। আজ তার দাম শোধ করার সময় এসেছে। আপনারা যান!" শম্ভু জ্যাঠা গর্জে উঠলেন।
অর্ক আর অনিমেষবাবু ইতস্তত করে সুড়ঙ্গে নামলেন। শম্ভু জ্যাঠা একাই লোকগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
সুড়ঙ্গের ভেতরে ভ্যাপসা অন্ধকার। ইঁদুর আর বাদুড়ের গন্ধ। হাঁটু পর্যন্ত নোংরা জল।
"অর্কবাবু," অনিমেষবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, "আমার মনে হচ্ছে আমরা কোনো ফাঁদে পা দিয়েছি। বীরেন্দ্রনারায়ণ এত সহজে আমাদের এখানে আসতে দেবেন, এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। এই সুড়ঙ্গটা যেন আমাদের জন্য তৈরিই ছিল।"
"আমারও তাই মনে হয়," অর্ক বললো। "নকশাটা হয়তো ভুল।"
"দাঁড়ান," অনিমেষবাবু বললেন। "পুঁথির শেষ কথাটা কী ছিল? 'যেখানে চন্দ্র আর সূর্য মিলিত হয় না'।"
"মানে?"
"মানে এমন একটা ঘর, যেখানে কোনোদিন আলো ঢোকে না। এই সুড়ঙ্গটা নয়। এটা দিঘির দিকে যাচ্ছে, এখানে আলো আসার কথা।"
"তাহলে?"
"নকশাটা দেখুন!" অনিমেষবাবু বললেন। "সুড়ঙ্গটা দিঘির দিকে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার ঠিক আগে, একটা ছোট্ট শাখা পথ... সোজা ঠাকুরঘরের দিকে ফিরে গেছে! যেখান থেকে আমরা শুরু করেছিলাম!"
"তার মানে," অর্কর চোখ জ্বলে উঠলো, "গুপ্তধনটা দিঘির তলায় নয়... ওটা ঠাকুরঘরের সেই গোপন কুঠুরিতেই আছে! 'যেখানে ছায়া আর জল মিলিত হয়' মানে দিঘি নয়, ওটা হলো সেই অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে ভূগর্ভস্থ ঘরটা!"
"আর 'সূর্যের প্রথম আলো ভূমি স্পর্শ করে'?"
"ঠাকুরঘরের বেদি!" অর্ক বললো। "বাড়ির নকশা আমার মনে আছে। ঠাকুরঘরটা এমনভাবে তৈরি যে, ঠিক ভোরের প্রথম আলোটা ওই বেদির ওপর এসে পড়ে! বেদিটাকে শুদ্ধ করার জন্য! ঈশ্বরচন্দ্র সেখানেই কিছু একটা রেখেছিলেন।"
"তার মানে, বীরেন্দ্রনারায়ণকে আমরা ভুল পথে চালিত করেছি!" অনিমেষবাবু হেসে উঠলেন। "সে এখন তার লোকেদের নিয়ে দিঘিতে পাঁক ঘাঁটবে।"
"আমাদের ফিরতে হবে," অর্ক বললো। "শম্ভু জ্যাঠার জন্য চিন্তা হচ্ছে।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion