প্রথম পরীক্ষা: ত্যাগের আলো
মন্দিরের প্রথম কক্ষটি ছিল অন্ধকার। ঘরের মাঝখানে একটি প্রাচীন সিন্দুক, আর তার ওপর জ্বলছে একটি ছোট প্রদীপ—যেন এটিই রূপেনের জ্বালানো প্রথম প্রদীপ। প্রদীপের শিখাটি স্থির নয়, যেন প্রতি মুহূর্তে নিভে যেতে চাইছে।
দেবু-দা ডায়েরি পড়ে বললেন, "রূপেন লিখেছেন, 'আলো স্থির হবে কেবল ত্যাগে, যেখানে হৃদয়ের প্রিয় বস্তুটি ভস্ম হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে'।"
অর্ণব চারপাশে তাকাল, কিন্তু ত্যাগের জন্য কিছু পেল না। তার সাথে আছে শুধু তার ব্যাগ, তার ফোন, আর রূপেনের ডায়েরি।
হঠাৎ সিন্দুকের ওপরে রাখা প্রদীপটি নিভে যাওয়ার উপক্রম হলো। ঘরের কোণে তৈরি হলো একটি কালো ছায়া, যা দ্রুত এগিয়ে আসছে। ছায়াটি দেবু-দার দিকে এগোচ্ছে।
"অর্ণব! আমি অসুস্থ! দ্রুত কিছু করো!" দেবু-দা হাঁপাতে লাগলেন।
অর্ণব বুঝতে পারল, ছায়াটি তার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস নয়, কিন্তু তার বর্তমান কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস—দেবু-দাকে কেড়ে নিতে চাইছে। অর্ণব দ্রুত তার পকেট থেকে তার বহু মূল্যবান, বহু কষ্টে তৈরি হওয়া ল্যাপটপের হার্ড ড্রাইভ বের করল, যা তার পেশাগত জীবনের সবটা। সে সেটা প্রদীপের দিকে এগিয়ে দিল।
দেবু-দা অবাক হয়ে বললেন, "কী করছ তুমি? তোমার কাজ, তোমার ভবিষ্যৎ!"
অর্ণব হার্ড ড্রাইভটা প্রদীপের শিখার কাছে ধরল। "আমার ভবিষ্যৎ মিষ্টির জীবনের চেয়ে দামি নয়!"
কিন্তু প্রদীপটি জ্বলল না, বরং আরও নিভে গেল। ছায়াটি এগিয়ে এল।
অর্ণব নিরাশ হয়ে হার্ড ড্রাইভটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তার হাতে শুধু রূপেনের ডায়েরি। এই ডায়েরি তার একমাত্র সূত্র, তার একমাত্র আশা।
"যদি এটাই সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হয়, তবে এটাই হোক ত্যাগ!" অর্ণব কাঁপতে কাঁপতে ডায়েরিটি প্রদীপের শিখার দিকে নিয়ে গেল। তার যুক্তিবাদী মন তখনও চিৎকার করছে—এটা করলে সব শেষ!
কিন্তু অর্ণবের মনে এল মিষ্টির মুখ, তার নিষ্পাপ হাসি। সে ডায়েরিটা শিখার কাছে ধরতেই... প্রদীপটি হঠাৎ তীব্র উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
"অপেক্ষা করো!" দেবু-দা চিৎকার করলেন। "ত্যাগ অর্থ ধ্বংস নয়, অর্পণ! রূপেন তোমাকে পরীক্ষা করছিলেন, তুমি কতটা নির্মোহ।"
তীব্র আলোয় ছায়াটি দূরে সরে গেল। সিন্দুকটি খুলে গেল। ভেতরে কোনো মন্ত্র নয়, বরং একটি ছোট, ভগ্ন আয়না পাওয়া গেল।
দ্বিতীয় পরীক্ষা: সত্যের কণ্ঠস্বর
দ্বিতীয় কক্ষটি ছিল একটি ছোট কুঠুরি। ভেতরে ঢুকতেই আলো নিভে গেল, আর চারপাশ থেকে ভেসে এল অজস্র ফিসফিস শব্দ। এই শব্দগুলো যেন সরাসরি অর্ণবের মনের গভীরে আঘাত হানছে।
"তুমি কি জানো, চন্দ্রিমা তোমারই রক্ত? রূপেন তাকে হত্যা করতে চায়নি, সে ভালোবাসত!"—একটি নারী কণ্ঠস্বর।
"তোমাকে আমরা মুক্তি দেব, যদি তুমি আমাদের কুলুঙ্গির অবস্থান বলে দাও! মুক্তি দাও!"—অন্য একটি পুরুষ কণ্ঠস্বর।
এগুলো ছিল ১৩ জন শিষ্যের কণ্ঠস্বর, যারা অর্ণবকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
অর্ণবের মনে পড়ল রূপেনের কথা: "শুদ্ধ মন্ত্রের অধিকারী হতে হলে, মনের মধ্যে কোনো সন্দেহ বা লোভ থাকতে পারবে না।"
সে বুঝতে পারল, এই ১৩ জন প্রেতাত্মা তাকে আবেগ দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
"তোমরা মিথ্যা বলছ! রূপেন ডাইনিকে বন্দি করেছিলেন, কারণ সে ছিল অমঙ্গল। তোমরা সবাই শিশুদের আত্মাকে ভোগ করতে চেয়েছিলে!" অর্ণব চিৎকার করল।
"কিন্তু মিষ্টির আলোই আমাদের চাই! দাও... দাও!"
অর্ণব স্থির থাকল। সে চোখ বন্ধ করে নিজেকে যুক্তি দিয়ে চালিত করল। "তোমরা চাওনি, তোমাদের নেত্রী চেয়েছিল। তোমরা সবাই রূপেনের বাঁধনে বন্দি। তোমাদের মুক্তি নেই। আমি তোমাদের মুক্তি দেব না।"
এই কথা বলার সাথে সাথে, ফিসফিস শব্দগুলো তীব্র আর্তনাদে পরিণত হলো এবং দূরে সরে গেল। আলো ফিরে এল। কক্ষের মেঝেতে একটি আয়তাকার পাথরের ফলক পাওয়া গেল। ফলকে কোনো মন্ত্র লেখা নেই, শুধু একটি ঠিকানা: "যেখানে আলো প্রবেশ করে না, যেখানে রক্ত মিশেছে মাটি আর জলে—সেইখানে শ্বেত প্রস্তরের নিচে বাঁধন পূর্ণ হবে।"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion