সূর্য ডুবে গেল। চারিদিকে অন্ধকার ঘনাল। আকাশের রং বদলে গেল গাঢ় নীল থেকে আলকাতরার মতো কালোয়। আকাশে কোনো তারা নেই, শুধু এক ফালি ক্ষীণ চাঁদ, যা ভূতের চতুর্দশীর অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলেছে। বাতাস ক্রমশ শীতল হচ্ছে, যেন পৃথিবী তার স্বাভাবিক তাপ হারাচ্ছে।
রাতের বেলা শুরু হল প্রদীপ জ্বালানোর প্রস্তুতি। ঠাকুমা কাঁপা হাতে প্রদীপের তালিকাটি অর্ণবের হাতে তুলে দিলেন। পরেশ প্রদীপের সরঞ্জাম নিয়ে অর্ণবের সাথে ঘুরছে।
"দেখ অর্ণব, এই ১৪টি জায়গার নাম লেখা আছে। মূল দরজার ডানপাশ, বাঁপাশ, তুলসীতলা, ঠাকুরঘরের সিঁড়ি, রান্নাঘরের কুলুঙ্গি, চিলেকোঠার গোপন কুঠুরি... সব ঠিকঠাক করবি। আজ রাতে কোনো এক শক্তি এই প্রদীপের বাঁধন ভাঙার চেষ্টা করবে।"
অর্ণব তালিকা ধরে একে একে প্রদীপ জ্বালাতে শুরু করল। প্রথম দিকের প্রদীপগুলো সহজেই জ্বলে উঠল। বাড়ির চারিদিকে একটা অস্পষ্ট পবিত্রতার আভা তৈরি হলো। ১২টি প্রদীপ জ্বলে উঠল।
১৩ নম্বর প্রদীপটা জ্বলে উঠল বাড়ির পূর্বাংশে, ঠাকুরঘরের ঠিক নিচে। এই প্রদীপের আলোটা বাকিগুলোর চেয়ে যেন বেশি কাঁপছিল। এরপর বাকি রইল শুধু ১৪ নম্বর।
তালিকায় লেখা: ১৪. পশ্চিমের দহলি ঘরের জানলার কুলুঙ্গি।
পশ্চিমের দহলি ঘর (পশ্চিমের মূল হলঘর) ছিল রায়চৌধুরী বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো আর অব্যবহৃত অংশ। অর্ণব লণ্ঠন হাতে সেই ঘরে প্রবেশ করল। ঘরটি ধুলো আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধে ভরা। জানলার কুলুঙ্গিটি ছিল দেওয়ালে ভাঙা একটি ফাঁকা জায়গা। এই কুলুঙ্গির ঠিক নিচে মেঝেতে একটা প্রাচীন, অচেনা প্রতীক খোদাই করা ছিল, যা ধুলোর নিচে ঢাকা। অর্ণব কুলুঙ্গিতে সর্ষের তেলের প্রদীপটি রাখল। দেশলাই কাঠি বের করার আগেই তার পকেটে থাকা ফোনটা আবার বেজে উঠল।
জরুরি কল। তার অফিসের বস। "হ্যাঁ, আমি কালই ফিরছি। না, না, চিন্তা করবেন না। একটা ছোট্ট কাজ বাকি," ফোনে কথা বলতে বলতে সে মনোযোগ হারাল। বস তাকে একটি জরুরি কোডিং ডিবাগ নিয়ে চাপ দিতে লাগল। অর্ণবের যুক্তিবাদী মন আবার জেঁকে বসল। "আরে বাবা, একটি প্রদীপ! আর মাত্র এক মিনিট ধরে ফোনটা ধরে থাকতে হবে..."
ফোনটা কেটে পকেটস্থ করল অর্ণব। সে ১৩টি জ্বলন্ত প্রদীপের দিকে একবার দেখল। "১৪ নম্বর? যাক গে, একটি প্রদীপ না জ্বালালে কী এমন হবে? ঠাকুমা তো আর দেখতে আসছে না। কাল সকালে জ্বালিয়ে দেব।" অর্ণব প্রদীপটিকে কুলুঙ্গিতে রেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার যুক্তিবাদী অবহেলা, আধুনিক জীবনের তাড়াহুড়ো—এই প্রাচীন প্রথার ওপর জয়ী হল। ১৪তম প্রদীপটি নিভে রইল, তার ভেতরে বন্দি থাকা চন্দ্রিমা ডাইনির বাঁধন রইল আলগা।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion