অর্ণব জানত, দৌড়ে গিয়ে মিষ্টিকে ধরলে প্রেতাত্মা তাকেও আঘাত করতে পারে। তখন মিষ্টির ক্ষতি আরও বেশি হবে। তাকে প্রথা মেনেই এই প্রেতাত্মাকে বাঁধতে হবে। কিন্তু তার হাতে সময় নেই। দহলি ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল, শেষ তিনটি প্রদীপও টলমল করছে, তাদের সলতে কালো হয়ে যাচ্ছে।
অর্ণবের মনে পড়ল রূপেনের ডায়েরির কথা। ডায়েরিতে লেখা ছিল, "চতুর্দশ কক্ষে সে বন্দি। মুক্তি কেবল তখনই, যখন সে আলোর পথ দিয়ে মুক্তি পাবে। বাঁধন ছিন্ন হলে তাকে ফের আলোর পথেই বাঁধতে হবে, কিন্তু সে আলো হবে বিশুদ্ধ, সন্দেহমুক্ত।"
অর্ণব মিষ্টিকে ডাকল না। উল্টো সে ছুটল দহলি ঘরের দিকে। জীবন আর মৃত্যু—মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দৌড়।
দহলি ঘরের মেঝেতে তখন ১৩টি প্রদীপ একে একে নিভে গেছে। শুধু শেষ প্রদীপটি মরিয়া হয়ে জ্বলছে। ঘরটা প্রায় অন্ধকারে ঢাকা। সেই জমাট অন্ধকার তার শরীর ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে, যেন অজস্র ঠান্ডা হাত তাকে টেনে ধরছে।
অর্ণব কুলুঙ্গির কাছে পৌঁছাল। নিভে থাকা ১৪ নম্বর প্রদীপটি তখনও কুলুঙ্গিতে রাখা। সে হাতে নিতেই তার হাত যেন জমে গেল, তেলের চটচটে ভাবটা বরফের মতো শীতল।
ঠিক সেই মুহূর্তে, শোবার ঘর থেকে সোমার চূড়ান্ত আর্তনাদ এল। মিষ্টির দেহটা জানলার ভাঙা কাঁচের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে।
অর্ণব মরিয়া হয়ে উঠল। তার পকেটে তখনও সেই দেশলাই কাঠি আর অবশিষ্ট সর্ষের তেল রাখা ছিল। সে নিজের ভেতরের সব সংশয় দূরে ঠেলে দিল। তার যুক্তিবাদী মন চিৎকার করে উঠলেও, সে শুধু মিষ্টির নিষ্পাপ হাসিটাই মনে রাখল।
কাঁপা হাতে সে সলতেয় তেল ঢালল, কাঠি ঘষল।
১ম কাঠি: ফুসসস... কাঠিটা জ্বলে, নিভে গেল। এটি সাধারণ হাওয়া নয়, চন্দ্রিমা ডাইনির মুক্ত নিঃশ্বাস—যা আগুনকে ভয় পায়।
২য় কাঠি: জ্বলে উঠল, কিন্তু দহলি ঘরের সিলিং থেকে ছায়া ঝরে পড়ল কাঠির উপর, সেটিও নিভে গেল। ঘরের ভেতরে একটা বিকট হাসি শোনা গেল, যা নারী আর পুরুষের মিশ্রণ।
পশ্চিমের জানলা দিয়ে তখন একটি বিকট, অস্পষ্ট আকৃতি ঘরে প্রবেশ করছে। সেটি মিষ্টির দিকে তাকিয়ে। প্রেতাত্মাটি এক ভয়ংকর, তীক্ষ্ণ শব্দ করে অর্ণবের দিকে ছুটে এল। আকৃতিটি দেখতে ঠিক যেন বিশাল একটি মাকড়সার জাল, যার প্রতিটি সুতো অন্ধকার দিয়ে বোনা।
অর্ণব প্রদীপটা কুলুঙ্গিতে রেখে প্রাণপণে সেটার সলতে ধরিয়ে দিল। শেষ দেশলাই কাঠি। হাতে আর কোনো কাঠি নেই। যদি না জ্বলে... সব শেষ।
৩য় কাঠি: অর্ণব নিজের সব শক্তি, সব বিশ্বাস একত্রিত করে কাঠিটা ঘষল। ক্র্যাক... জ্বলে উঠল! এই আলো ছিল সন্দেহমুক্ত, বিশুদ্ধ।
যে মুহূর্তে ১৪ নম্বর প্রদীপটি জ্বলে উঠল, ঠিক সেই মুহূর্তেই দহলি ঘরে যেন একটা ছোটখাটো বিস্ফোরণ ঘটল। তীব্র, সাদা আলোয় ঘরটা ঝলসে গেল। মনে হলো যেন লক্ষ সূর্য একসাথে জ্বলে উঠেছে। আলো এত তীব্র ছিল যে অর্ণব চোখ বন্ধ করে ফেলল।
ছায়া-প্রেতাত্মা একটি অসহ্য, ধাতব চিৎকার করে উঠল, যা কানে তালা লাগিয়ে দিল। সেই বিশাল, অস্পষ্ট ছায়াটি দ্রুত সংকুচিত হতে শুরু করল। আলোটি তাকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ছায়াটি যেন তীব্র বেগে প্রদীপের দিকে আকৃষ্ট হল, এবং চোখের পলকে প্রদীপের ছোট্ট শিখার মধ্যে টেনে নেওয়া হল।
প্রদীপটি এখন স্থির। ১৪টি প্রদীপই এখন জ্বলছে। তবে ১৪ নম্বর প্রদীপটির শিখা অন্য ১৩টির চেয়ে উজ্জ্বল, স্থির এবং শক্তিশালী। ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হল। জমাট অন্ধকার আর নেই, শুধু প্রদীপের পবিত্র হলুদ আলো।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion