ভোরের আলো যখন বড়বাড়ির স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালে পড়ল, তখন এক ভয়ানক নীরবতা চারিদিকে। আগের রাতের ঘটনা যেন সবাইকে এক কঠিন বাস্তবতার মুখে এনে ফেলেছে। মিষ্টি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেও, তার মা সোমা পুরোপুরি বিপর্যস্ত। সোমা শহরের মেয়ে, এই ধরনের ভৌতিক বা তান্ত্রিক বিশ্বাসে তার কোনো আস্থা ছিল না। এখন সে দেখেছে, তার চোখের সামনে তার সন্তানকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক অশরীরী ছায়া।
ডাইনিং টেবিলে সোমা অর্ণবের দিকে কঠিন চোখে তাকাল। "আমরা কালই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব, অর্ণব। তুমি থাকতে চাইলে থাকো, কিন্তু আমার মেয়েকে এই অভিশাপের মুখে আমি আর রাখতে পারব না।"
অর্ণব শান্তভাবে চায়ে চুমুক দিল। "সোমা, পালানো সম্ভব নয়। রূপেনের ডায়েরি পড়ে যা বুঝলাম, এই বাঁধন বাড়ির সাথে যুক্ত নয়, এটা বংশের রক্তের সাথে বাঁধা। আমরা যেখানেই যাই না কেন, চন্দ্রিমা আমাদের পিছু ছাড়বে না। তাছাড়া, ১৪ নম্বর প্রদীপটা আমি জ্বালিয়েছি, তাই ওর প্রথম লক্ষ্য আমি নই, কিন্তু ওর প্রতিশোধের উদ্দেশ্য হলো বংশের সবচেয়ে মূল্যবান 'আলো'—অর্থাৎ মিষ্টি।"
ঠাকুমা, দুর্বল শরীর নিয়ে মেঝেতে বসে রূপেনের ডায়েরি ঘাঁটছিলেন। তিনি বললেন, "অর্ণব ঠিক বলছে। চন্দ্রিমা জানে, এক বছর পর তার মুক্তি নিশ্চিত। আমরা এখন পালালে, সে আরও শক্তিশালী হবে। তাকে চিরতরে বাঁধতে হলে 'শুদ্ধ মন্ত্র' চাই।"
অর্ণব রাতে ভালো করে ডায়েরিটা পড়ল। এটি কেবল রূপেনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, বরং তন্ত্র সাধনার এক গোপন নথি। ডায়েরিতে লেখা:
"আমি চন্দ্রিমাকে বাঁধলাম, কিন্তু ভস্ম করতে পারলাম না। আমার শুদ্ধ মন্ত্রের শক্তি তখনও অপূর্ণ। এই মন্ত্র লিখিত রূপে রাখা সম্ভব নয়, কারণ প্রতিটি অক্ষরই শক্তির প্রতীক। মন্ত্রটি লুকানো আছে, যেখানে কালিকার চরণ স্পর্শে পাথরও কাঁপে। সেই স্থানেই আমার সাধনা পূর্ণ হবে। যে বংশধর সেই স্থানে গিয়ে শুদ্ধ মন নিয়ে কালিকার আশীর্বাদ চাইবে, সেই সেই মন্ত্রের অধিকারী হবে। শুদ্ধ মন্ত্র কেবল কণ্ঠে থাকে, কাগজে নয়।"
অর্ণব বুঝে গেল, 'শুদ্ধ মন্ত্র' কোথাও লেখা নেই। তাকে এমন একটি স্থান খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে রূপেন তার সাধনা করেছিলেন। ডায়েরির ভেতরের অংশে, একটি হাতে আঁকা নকশা পাওয়া গেল—একটি রুক্ষ, ভাঙাচোরা মন্দিরের প্রতিকৃতি, যার নিচে লেখা: "বিস্মৃত কালিকার মন্দির, দগ্ধ বন।"
সন্ধ্যা হতেই অর্ণব দেখল প্রথম বিপদ। পশ্চিমের দহলি ঘরে যেখানে ১৪ নম্বর প্রদীপটি জ্বলছিল, সেই ভাঙা কুলুঙ্গির ফাটল থেকে একটি ছোট, ঘন কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে এসে ঘরের কোণে মিলিয়ে গেল। এটি ছিল প্রেতাত্মার ক্ষুদ্র একটি অংশ, যা ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসছে। পরেশ এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে ওঠে, "ছায়া-পোকা! এটা হলো মুক্তির চেষ্টা! বাঁধন দুর্বল হচ্ছে!"
অর্ণব সিদ্ধান্ত নিল। সে তার যুক্তিবাদী পরিচিতদের কাছে নয়, বরং এই প্রাচীন বিদ্যার বিশেষজ্ঞের কাছে যাবে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion