Episode 10626 words2 views

নবম অধ্যায়: ছন্দ ও আত্মা

লেক গার্ডেনস-এর গলিটা শান্ত। দুপুরবেলা বলে লোকচলাচল কম। একটা পুরোনো দোতলা বাড়ির সামনে "ছন্দ ও আত্মা" লেখা একটা বিবর্ণ সাইনবোর্ড ঝুলছে। রিয়া আর রাতুল একটা অটোতে করে এসেছে। রাতুল হেলমেটটা খোলেনি। সে অটোর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তার উল্টোদিকের একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। হেলমেটটা এমনভাবে রাখল যেন মুখটা আড়াল থাকে। রিয়ার সাথে তার ফোনে কলটা কানেক্ট করা আছে। রিয়া একাই বাড়ির ভেতরে ঢুকল। ভেতরটা শান্ত। একটা বড় হলঘর থেকে ঘুঙুরের হালকা আওয়াজ আসছিল। রিয়া দেখল, একজন মাঝবয়সী মহিলা, পরনে সুতির শাড়ি, চুলটা খোঁপা করা, কয়েকজন ছোট ছোট মেয়েকে কথকের মুদ্রা শেখাচ্ছেন। "আমি কি একটু সাহায্য করতে পারি?" মহিলাটি রিয়াকে দেখে এগিয়ে এলেন। তার মুখটা শান্ত, কিন্তু চোখ দুটো গভীর। "নমস্কার। আমি আমার বোনের মেয়ের জন্য এসেছিলাম। ও নাচ শিখতে চায়," রিয়া যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল। "বসুন।" মহিলাটি তাকে একটা বেঞ্চে বসতে ইশারা করলেন। "আমার নাম মালবিকা রায়। আমিই এখানে শেখাই।" "খুব সুন্দর শেখান আপনি," রিয়া বলল। "আসলে, আমি এই স্কুলটার কথা আমার এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম। সে-ও আপনার খুব ভক্ত ছিল। অনন্যা সেন।" নামটা শোনার সাথে সাথেই মালবিকা রায়ের মুখটা শক্ত হয়ে গেল। তিনি মেয়েদের ছুটি দিয়ে দিলেন। "তোমরা আজ যাও। কাল সকালে এসো।" মেয়েরা চলে গেলে তিনি দরজাটা বন্ধ করে রিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালেন। "আপনি কে? পুলিশ? না মিডিয়া?" "মিডিয়া," রিয়া সত্যিটাই বলল। "কলকাতার ক্রাইম।" "তাহলে এখানে কিছু পাওয়ার আশা নেই," মালবিকা রায় ঘুরে দাঁড়ালেন। "অনন্যাকে নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।" "ও কি আপনার ছাত্রী ছিল?" "ছাত্রী?" মালবিকা রায় হাসলেন। "ও আমার মেয়ের মতো ছিল। এই গ্ল্যামারের জগতটা ওকে শান্তি দেয়নি। ও এখানে আসত... ওই জগতটা থেকে পালানোর জন্য। ও বলত, 'মালবিকা দি, আমার এই মেক-আপের আড়ালে যে অনন্যাটা আছে, সে শুধু তোমার এই হলঘরেই নিঃশ্বাস নিতে পারে'।" রিয়ার বুকটা ধুক করে উঠল। "ও... ও কি নিখোঁজ হওয়ার আগে আপনার সাথে যোগাযোগ করেছিল?" মালবিকার চোখ দুটো জলে ভরে এল। "করেছিল। খুব ভয় পেয়েছিল। বলছিল, 'ওরা আমাকে ছাড়বে না দিদি। আমি এমন কিছু জেনে ফেলেছি, যা আমার জানার কথা ছিল না'।" "ও কি আপনাকে কিছু রেখে যেতে বলেছিল? কিছু..." মালবিকা রিয়াকে থামিয়ে দিলেন। তিনি তার শাড়ির আঁচলের ভাঁজ থেকে একটা চাবি বের করলেন। "হ্যাঁ, দিয়েছিল।" তিনি একটা পুরোনো স্টিলের আলমারির দিকে এগিয়ে গেলেন। "ও আমাকে একটা জিনিস দিয়েছিল। বলেছিল, 'যদি দেখো আমি বিপদে পড়েছি, যদি দেখো আমার ফোন সুইচড অফ, তাহলে এটা তুমি এমন একজনকে দেবে, যার নাম রাতুল সেনগুপ্ত'।" রাস্তার ওপারে, চায়ের দোকানে বসে থাকা রাতুল তার কানে লাগানো ইয়ারপিসে এই কথাগুলো শুনে শিউরে উঠল। রিয়াও বিস্ময়ে হতবাক। "রাতুল সেনগুপ্ত? আপনি তাকে চেনেন?" "চিনি না," মালবিকা বললেন। "আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কে সে? অনন্যা হেসেছিল। বলেছিল, 'ও একজন খুব সাধারণ লোক। একজন অ্যাকাউন্টেন্ট। ও একমাত্র লোক, যাকে ওই শয়তানগুলো সন্দেহ করবে না। ও-ই পারবে এটা ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে। ও-ই আমার একমাত্র 'সেফটি নেট'।' মালবিকা আলমারি খুলে একটা ছোট বাক্স বের করলেন। তার ভেতর থেকে একটা সাধারণ, দেখতে একদম নিরীহ, রুপোর লকেট বের করলেন। লকেটটা একটা ডমরুর মতো দেখতে। "এটা?" রিয়া অবাক হলো। "পেন ড্রাইভটা কোথায়?" "এটাই সেই পেন ড্রাইভ," মালবিকা বললেন। "অনন্যা বলেছিল, এটা দেখতে লকেট হলেও, এটা আসলে একটা কাস্টম-মেড পেন ড্রাইভ। এর ভেতরেই সব আছে।" রিয়া কাঁপা কাঁপা হাতে লকেটটা নিল। সে পেয়েছে! তারা পেয়েছে! "তাড়াতাড়ি করুন, রিয়া!" রাতুলের গলাটা ইয়ারপিসে চেঁচিয়ে উঠল। "আমি দুটো লোককে বাইকে করে গলির মুখে দাঁড়াতে দেখলাম! ওদের মধ্যে একজনের মুখে কাটার দাগ! কালাম!" রিয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে কিছু বলার আগেই, "ছন্দ ও আত্মা"-এর সদর দরজাটা সশব্দে লাথি মেরে খুলে ফেলল কেউ। কালাম আর ইন্সপেক্টর সান্যাল ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পেছনে আরও দুজন। "খুব চালাকি, তাই না ম্যাডাম?" সান্যাল হাসতে হাসতে বলল। "ভেবেছিলে আমরা ভিকির মতো একটা ছোট মাছ ধরেই থেমে যাব? আমরা প্রথম থেকেই তোমাদের পেছনে লেগেছিলাম। সুব্রত রায়ের অফিস থেকেই তোমাদের পিছু নিয়েছি।" রিয়ার হাত মুঠোর মধ্যে লকেটটাকে চেপে ধরল। "দিয়ে দিন," কালাম তার দিকে হাত বাড়াল। "ভালোয় ভালোয় দিয়ে দিলে আমরা মালবিকা দি-কে কিছু করব না। আর রাতুলবাবু... উনি তো বাইরে চায়ের দোকানে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষাই করছেন। তাই না?"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion