Episode 11598 words2 views

দশম অধ্যায়: হাতবদল

"আর রাতুলবাবু... উনি তো বাইরে চায়ের দোকানে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষাই করছেন। তাই না?" ইন্সপেক্টর সান্যালের ব্যঙ্গাত্মক হাসিতে "ছন্দ ও আত্মা"-এর হলঘরটা যেন জমে গেল। রিয়া তার মুঠির মধ্যে ডমরু-আকৃতির লকেটটা শক্ত করে চেপে ধরল। সে বুঝতে পারছিল, এটা একটা ফাঁদ। সুব্রতদার অফিস থেকেই ওদের অনুসরণ করা হয়েছে। রাতুল বাইরে একা, আর সে ও মালবিকা ভেতরে—চারজন সশস্ত্র লোকের সামনে। রাস্তার ওপারে, চায়ের দোকানে বসে রাতুল সবটা শুনছিল তার কানে লাগানো ইয়ারপিসে। সান্যালের শেষ কথাটা শোনার সাথে সাথে তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ওরা তাকেও চিনে ফেলেছে! "দিন, ম্যাডাম। লকেটটা দিন," কালাম তার নোংরা হাতটা রিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল। "বেশি চালাকি করলে কিন্তু দিদিমণির (মালবিকার দিকে ইঙ্গিত করে) খুব কষ্ট হবে।" মালবিকা রায় ভয়ে কাঁপছিলেন, কিন্তু তার চোখে ঘৃণা স্পষ্ট। রিয়া এক মুহূর্ত ভাবল। সে যদি লকেটটা দিয়ে দেয়, তবে ওদের তিনজনের মৃত্যুই নিশ্চিত। প্রমাণ লোপাট করতে সান্যাল এক মুহূর্তও ভাববে না। আর যদি না দেয়, তাহলেও ওরা জোর করে কেড়ে নেবে। "কী ভাবছেন?" সান্যাল তার রিভলবারটা বের করে মালবিকার কপালে ঠেকালো। "তিন সেকেন্ড সময় দিলাম। এক..." রাতুল ইয়ারপিসে সবটা শুনছিল। মালবিকার চাপা গোঙানি, সান্যালের নিষ্ঠুর গলা। তার ভেতরের নিরীহ অ্যাকাউন্টেন্ট সত্তাটা ততক্ষণে মরে গেছে। সে দেখল, ডান্স স্কুলের দরজাটা খোলা। সান্যাল আর কালাম রিয়ার দিকে এগিয়ে আছে। "দুই..." "রিয়া!" রাতুল তার ফোনের মধ্যে দিয়ে চিৎকার করে উঠল। "দরজা! দরজার দিকে ছোঁড়ো! এক্ষুনি!" সান্যাল কিছু বোঝার আগেই, রিয়া তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, "ধরুন!" সে লকেটটা দরজার দিকে ছুঁড়ে মারল না। সে সটান ওটা ছুঁড়ে মারল হলঘরের কোণে রাখা একটা বড় সেতারের দিকে। "ধ্রাং!" প্রচণ্ড শব্দে সেতারটা উল্টে পড়ল। সান্যাল, কালাম—সবার নজর সেদিকে। এটা একটা পরিকল্পিত বিভ্রান্তি। "না!" রিয়া আবার চিৎকার করল, "রাতুলবাবু, নিন!" এইবার, সে তার মুঠিতে রাখা আসল লকেটটা—সেই রুপোর ডমরু—সজোরে ছুঁড়ে মারল খোলা দরজাটা দিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে। "শালা!" সান্যাল যখন বুঝল সে প্রতারিত হয়েছে, তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। লকেটটা একটা রুপোলি বিন্দুর মতো ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল রাস্তার ধুলোর ওপর। কালাম আর তার লোকেরা সেটা তোলার জন্য দরজার দিকে দৌড়ানোর আগেই, একটা ছায়ামূর্তি ঝড়ের বেগে চায়ের দোকান থেকে ছুটে এল। তার মাথায় হেলমেট, পরনে জ্যাকেট। রাতুল! সে এক ঝটকায় নিচু হয়ে ধুলো থেকে লকেটটা তুলে নিল। "ধর ওকে!" সান্যাল চিৎকার করে উঠল। "ওই শালাই রাতুল!" কালাম আর তার দুই সঙ্গী রাতুলের পেছনে দৌড়ল। রাতুল তার জীবনের সবচেয়ে জোরে দৌড়োচ্ছে। সে জানে না সে কোথায় যাচ্ছে। লেক গার্ডেনস-এর এই গলি তার চেনা নয়। সে শুধু জানে, তাকে বাঁচতে হবে। এই লকেটটা... এটাই অনন্যার শেষ ভরসা। "ছন্দ ও আত্মা"-এর ভেতরে, সান্যাল রিয়ার চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে তুলল। "খুব সাহস না তোর? ভাবলি, ওটা নিয়ে ও বেঁচে যাবে?" রিয়া হাসল। তার ঠোঁটের কোণে রক্ত। "ও বেঁচে যাবে। আর আপনিও ধরা পড়বেন।" "ওকে ধর!" সান্যাল তার ওয়াকি-টকিতে গর্জে উঠল। "শুট অ্যাট সাইট! ছেলেটাকে দেখলেই গুলি কর! ও একজন খুনি আসামী!" সান্যাল রিভলবারের বাঁটটা দিয়ে রিয়ার মাথায় আঘাত করল। রিয়া জ্ঞান হারিয়ে মালবিকা রায়ের গায়ের ওপর ঢলে পড়ল। "গাড়িতে তোল এদের," সান্যাল হুকুম দিল। "এদের জ্যান্ত ধরে রাখলে তবেই ওই পেন ড্রাইভটা ফেরত আসবে।" বাইরে তখন এক অন্য লড়াই শুরু হয়ে গেছে। রাতুল সরু গলি দিয়ে দৌড়োচ্ছে। পেছনে কালাম আর তার দলবল। "দাঁড়া, বদমাশ!" কালামের গলা। রাতুল একটা পাঁচিল দেখতে পেল। সে এক লাফে সেটা টপকে একটা বাড়ির পেছনের বাগানে গিয়ে পড়ল। সে হেলমেটটা এখনো খোলেনি। ওটাই তার মুখ বাঁচিয়ে রেখেছে। সে দৌড়াতে দৌড়াতে একটা অটো স্ট্যান্ডের কাছে এসে পড়ল। একটা চলন্ত অটোতে সে প্রায় লাফিয়ে উঠে পড়ল। "তাড়াতাড়ি চালান! ডবল ভাড়া দেব!" অটোওয়ালা কিছু বোঝার আগেই রাতুল ভেতরে। কালামরা যখন মোড়ে এসে পৌঁছাল, তখন অটোটা ধোঁয়া তুলে মিলিয়ে যাচ্ছে। রাতুল তার হেলমেটটা খুলল। তার সারা শরীর কাঁপছে। সে লকেটটা মুঠোয় চেপে ধরল। সে পালিয়েছে। কিন্তু রিয়া... রিয়া আর মালবিকা ধরা পড়ে গেছে। সে এখন একা। হাতে প্রমাণ। কিন্তু বন্ধুরা শত্রুর কবলে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion