Episode 9539 words2 views

অষ্টম অধ্যায়: দ্বিতীয় সূত্র

"খুনি!" খবরের কাগজের স্কেচটার দিকে তাকিয়ে রাতুল সেনগুপ্ত বিড়বিড় করে উঠল। তার সাজানো, নিরীহ জীবনটা যে এভাবে ধসে পড়তে পারে, তা সে দু'দিন আগেও কল্পনা করতে পারেনি। "সুব্রতদা, এখন আমরা কী করব?" রিয়ার গলায় এবার সত্যিকারের ভয়। "ওরা রাতুলবাবুকে ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। গোটা পুলিশ ফোর্স এখন ওনাকে খুঁজবে। ওনাকে পেলেই সান্যাল... হয়তো গুলি করে দেবে। বলবে, 'এনকাউন্টারে' মারা গেছে।" সুব্রত রায় তার ডেস্কের ওপর দু'হাতের আঙুলগুলো দিয়ে বাজনা বাজানোর মতো শব্দ করতে লাগলেন। ঘরটার মধ্যে একটা দমবন্ধ করা স্তব্ধতা। "ঠিক এটাই ওরা চায়," সুব্রতদা অবশেষে বললেন। "ওরা চায় তোমরা ভয় পাও। ওরা চায় রাতুল ভয় পেয়ে এমন কিছু করুক যাতে ওকে 'দোষী' প্রমাণ করা সহজ হয়। কিন্তু আমরা সেটা হতে দেব না।" "কীভাবে?" রাতুলের স্বরটা এক সপ্তাহ আগের সেই ভীতু অ্যাকাউন্টেন্টের নয়। গত দু'দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার ভেতরের মানুষটাকে কঠিন করে তুলেছে। সুব্রতদা বললেন, "দুটো জিনিস। এক, রাতুলকে তার ভোল পাল্টাতে হবে। এই মুহূর্তে। রিয়া, আমার অফিসের পেছনের ঘরে একটা ছোট বাথরুম আছে। ওখানে একটা ফার্স্ট-এইড বক্স পাবে। তাতে দাড়ি কাটার সেভিং কিট, কাঁচি সব আছে। রাতুল, যাও। তোমার ওই 'ভদ্রলোক' গোছের গোঁফটা কামিয়ে ফেলো। চুলটা এলোমেলো করে কেটে ফেলো। তোমার চেনা 'রাতুল সেনগুপ্ত'-কে আয়না থেকে মুছে ফেলো।" রাতুল এক মুহূর্ত দ্বিধা করল। তারপর উঠে দাঁড়াল। "আর দুই নম্বর?" সুব্রতদা রিয়ার দিকে তাকালেন। "দুই, পেন ড্রাইভ। আমাদের ওটা পেতেই হবে। অনন্যা বলেছিল, ওটা 'সেফ জায়গায়' আছে। আর তার কিছু হলে ওটা মিডিয়ার কাছে যাবে। অনন্যা কার কাছে মিডিয়ার কথা বলেছিল?" "ভিকির সামনে... অখিলেশ ঝা-কে বলেছিল," রিয়া বলল। "তার মানে," সুব্রতদা বললেন, "অনন্যা জানত যে ও এই কথাটা বললে ঝা ভয় পাবে। তার মানে, পেন ড্রাইভটা এমন কারোর কাছে আছে, যার মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ আছে। বা, যে নিজেই মিডিয়া।" "আমার মতো?" রিয়া বলল। "হতে পারে। বা আমার মতো," সুব্রতদা বললেন। "কিন্তু তোমরা দুজনেই অনন্যাকে চিনতে না। আচ্ছা, অনন্যার কোনো বন্ধু ছিল... মডেলিং ওয়ার্ল্ডের বাইরে? এমন কেউ যাকে ও অন্ধের মতো বিশ্বাস করত?" রিয়া তার ফোনটা (যেটা সুব্রতদার অফিসের ওয়াই-ফাই দিয়ে সে এতক্ষণ ব্যবহার করছিল, সিম কার্ড খুলে) হাতে তুলে নিল। "আমি ওর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলগুলো দেখছিলাম। বেশিরভাগই গ্ল্যামারাস পার্টির ছবি, ডিজাইনারদের সাথে পোজ। কিন্তু..." রিয়া একটা ছবির ওপর জুম করল। "গত এক বছরে, অনন্যা বারবার একটা জায়গায় চেক-ইন করেছে। অদ্ভুত জায়গা।" "কোথায়?" "'ছন্দ ও আত্মা' ডান্স অ্যাকাডেমি। লেক গার্ডেনস-এ।" রাতুল বাথরুম থেকে অর্ধেক গোঁফ কামানো অবস্থায় মুখ বের করল। "ডান্স অ্যাকাডেমি?" "হ্যাঁ," রিয়া বলল। "একজন হাই-ফ্যাশন মডেল, যে পার্ক স্ট্রিটে পার্টি করে, সে লেক গার্ডেনস-এর একটা সাধারণ নাচের স্কুলে কেন যাবে? আর দেখুন, প্রতি মাসে অন্তত চার-পাঁচবার গেছে।" সুব্রতদার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। "এটাই। এটাই আমাদের সূত্র। ঝা-এর লোক 'বেঙ্গল লাউঞ্জ' বা অনন্যার ফ্ল্যাটে পেন ড্রাইভটা খুঁজবে। তারা সোনাগাছিতে খুঁজবে। কিন্তু তারা একটা ছাপোষা নাচের স্কুলে খুঁজবে না।" "তাহলে আমরা ওখানে যাব," রিয়া উঠে দাঁড়াল। "দাঁড়াও," সুব্রতদা বললেন। "তুমি একা যাবে। রাতুল এখানেই থাকবে। ও এখন 'ওয়ান্টেড'। ওকে নিয়ে বেরোনো মানে..." "না," বাথরুম থেকে রাতুলের গলা ভেসে এল। সে পুরো শেভ করে, চুলটা কাঁচি দিয়ে অদ্ভুতভাবে ছেঁটে ফেলেছে। তার চেহারার 'নিরীহ' ভাবটা অনেকটাই কেটে গেছে। "আমি যাব। আমি আর লুকিয়ে থাকব না। ওই ফোনটা আমার কাছে এসেছিল। ওই মহিলা আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। আমি শেষটা দেখেই ছাড়ব।" সুব্রতদা তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার আলমারি থেকে একটা পুরোনো মোটরবাইক হেলমেট আর একটা জ্যাকেট বের করলেন। "এটা পরো। আর রিয়া, তোমাকে এমনভাবে যেতে হবে যেন তুমি ছাত্রী ভর্তি করতে যাচ্ছ। কোনোভাবেই যেন তাদের সন্দেহ না হয়।"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion