রাত তখন প্রায় একটা। ধর্মতলায় সুব্রত রায়ের অফিস।
"কলকাতার আয়না"-এর ছোট ঘরটায় সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে গেছে। রাতুল সেনগুপ্ত সোফায় বসে আছে, তার দু'হাতের মধ্যে মাথা গোঁজা। তার সামনে টেবিলে রাখা রুপোর ডমরু-লকেটটা। একটু আগেই সে এটার ভেতরের ভয়াবহ ভিডিওগুলো দেখেছে।
"কী ঠিক করলে?" সুব্রত রায় তার কাঁধে হাত রাখলেন। "ভোর পাঁচটা বাজতে বেশি দেরি নেই।"
"আমি যাব," রাতুল সোজা হয়ে বসল। তার চোখ দুটো লাল, কিন্তু দৃষ্টিটা স্থির। গত তিনদিনে এই লোকটার ভেতরের নিরীহ, ভীতু মানুষটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
"একা?"
"একা। ওরা তাই বলেছে।"
"তুমি একা নও, রাতুল," সুব্রতদা বললেন। "ওরা তোমার বন্ধুদের জিম্মি করেছে, প্রমাণটা চায়। কিন্তু ওরা জানে না, এই প্রমাণ এখন শুধু আর তোমার বা আমার কাছে নেই।"
সুব্রতদা তার ল্যাপটপটা ঘোরালেন। "আমি গত এক ঘন্টায় লকেটটার সব ডেটা কপি করেছি। শুধু কপি করিনি, দশটা আলাদা সার্ভারে আপলোড করে টাইম-লক করে দিয়েছি।"
"মানে?"
"মানে," সুব্রতদা হাসলেন, "কাল সকাল ছ'টা বাজার সাথে সাথে এই সব ভিডিও আর অডিও ক্লিপ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দফতর, সি.বি.আই ডিরেক্টরেট, প্রধানমন্ত্রীর অফিস আর দেশের প্রথম সারির দশটা মিডিয়া হাউসের এডিটরের ইনবক্সে অটোমেটিক্যালি পৌঁছে যাবে।"
রাতুল চমকে উঠল। "তাহলে তো রিয়া আর মালবিকা দেবীর..."
"না," সুব্রতদা তাকে থামালেন। "ছ'টার আগে কিচ্ছু হবে না। পাঁচটায় তোমার মিটিং। তোমার হাতে ঠিক এক ঘন্টা সময় আছে। তুমি হাওড়া ব্রিজে যাবে। ওদের সাথে কথা বলবে। রিয়া আর মালবিকাকে ছাড়িয়ে আনবে। আর ঠিক ৫:৫৫ মিনিটে, তুমি আমাকে শুধু একটা 'ওকে' মেসেজ পাঠাবে। তাহলেই আমি এই টাইম-লক ডিফিউজ করে দেব। সব ডেটা সার্ভার থেকে মুছে যাবে। কেউ কিছু জানবে না।"
রাতুল তার পরিকল্পনাটা বুঝল। এটা একটা দু'মুখী তলোয়ার। "আর... আর যদি আমি মেসেজ না পাঠাই? যদি ওরা আমার ফোন কেড়ে নেয়?"
সুব্রত রায়ের মুখটা কঠিন হয়ে গেল। "তাহলে ঠিক সকাল ছ'টায়, অখিলেশ ঝা আর মন্ত্রী আশীষ বর্মণের কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে। রিয়া আর মালবিকা দেবীর জীবনের বিনিময়ে... গোটা রাজ্যটা অন্তত পরিষ্কার হবে। অনন্যা সেনের আত্মা শান্তি পাবে।"
রাতুল চুপ করে রইল। সুব্রতদা তার হাতে একটা ছোট বাটন ফোন ধরিয়ে দিলেন। "এটাতে শুধু আমার নম্বরই আছে। আর কিছু নেই।"
রাতুল লকেটটা হাতে তুলে নিল। ওটা আবার গলায় পরে নিল। "চলুন, হিসেবটা শেষ করে আসি।"
ভোর ৪:৪৫।
হাওড়া ব্রিজ। গঙ্গার ওপরটা ঘন কুয়াশায় ঢাকা। পুবদিকের তিন নম্বর পিলারের নিচেটা প্রায় অন্ধকার। শুধু দূরে রাস্তায় কয়েকটা ট্রাকের হেডলাইট ছাড়া আর কোনো আলো নেই।
রাতুল তার জ্যাকেটের কলারটা তুলে পিলারের নিচে এসে দাঁড়াল। সময় যেন থমকে গেছে।
ঠিক পাঁচটায়, অন্ধকার থেকে দুটো ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল।
ইন্সপেক্টর সান্যাল আর কালাম।
"এসেছিস?" সান্যালের গলায় হিংস্র আনন্দ। "ভেবেছিলাম, ভয় পেয়ে আর আসবি না।"
"ওরা কোথায়?" রাতুলের গলাটা শান্ত, অস্বাভাবিক রকমের শান্ত।
কালাম শিস দিল। পিলারের আড়াল থেকে একটা গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে এগিয়ে এল। পেছনের সিটে রিয়া আর মালবিকা রায়কে দেখা যাচ্ছে। রিয়ার মাথায় ব্যান্ডেজ। মালবিকা ভয়ে কাঁপছেন।
"লকেটটা," সান্যাল হাত বাড়াল। "আগে লকেট, তারপর মেয়ে।"
"না," রাতুল মাথা নাড়ল। "আগে ওদের ছাড়ুন। ওরা ওই ট্যাক্সিতে উঠবে," সে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা হলদে ট্যাক্সির দিকে ইশারা করল। "ট্যাক্সিটা ব্রিজ পার হলেই, আমি আপনাকে লকেটটা দিয়ে দেব।"
"শালা!" কালাম রিভলবারটা বের করে রাতুলের বুকে ঠেকালো। "বেশি চালাকি করবি?"
"চালাকি নয়, হিসেব," রাতুল বলল। "মারুন। আমাকে গুলি করুন। লকেটটা আমার গলায়। ওটাও নষ্ট হয়ে যাবে। আর আমার কী হবে জানি না, কিন্তু আপনার বস অখিলেশ ঝা আপনাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।"
সান্যাল এক মুহূর্ত ভাবল। সে কালামকে ইশারা করল।
কালাম গাড়ির দরজা খুলে রিয়া আর মালবিকাকে প্রায় ধাক্কা মেরে বের করে দিল। "যা, ভাগ!"
রিয়া টলতে টলতে রাতুলের দিকে তাকাল। "রাতুলবাবু, যাবেন না! পালাবেন না! ওদের বিশ্বাস করবেন না!"
"চুপ কর!" সান্যাল রিয়ার গালে একটা থাপ্পড় মারল।
"যাও, রিয়া," রাতুল চিৎকার করে বলল। "ট্যাক্সিতে ওঠো! আমার কথা শোনো! যাও!"
মালবিকা রিয়াকে টেনে নিয়ে ট্যাক্সিটার দিকে দৌড় দিলেন। ট্যাক্সিটা স্টার্ট দিল।
সান্যাল হাসল। "এবার? তোর বন্ধুরা তো চলে গেল। এবার লকেটটা খোল।"
"বন্ধুরা চলে গেছে। কিন্তু শয়তানরা তো যায়নি," রাতুল হাসল।
"মানে?"
"মানে, অখিলেশ ঝা-কে আসতে বলুন," রাতুল বলল। "এই লকেট আপনার মতো ছোটখাটো লোকের হাতে দেওয়ার জন্য নয়। এটা আমি ওঁর হাতেই দেব।"
সান্যালের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ঠিক তখনই, কুয়াশার ভেতর থেকে একটা ভারী গলার স্বর ভেসে এল।
"ছেলেটার খুব সাহস দেখছি, সান্যাল।"
একটা কালো মার্সিডিজ থেকে নেমে এল অখিলেশ ঝা। পরনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। তার চোখে কোনো ভয়ডর নেই।
"খুব খেললি তোরা ক'দিন ধরে," ঝা একটা চুরুট ধরাল। "আমার ক্লাবে, আমার মডেল, আমার পুলিশ... সবকিছুর মধ্যে নাক গলিয়েছিস। নে, এবার জিনিসটা দে। বাড়ি যা।"
রাতুল তার গলা থেকে লকেটটা খুলল। "একটা প্রশ্ন ছিল। অনন্যা সেন... কেন মারলেন ওকে?"
ঝা হাসল। "কারণ ও বড্ড বেশি বুঝে ফেলেছিল। ও ভেবেছিল, এই ভিডিওগুলো দিয়ে ও আমার থেকে মুক্তি পাবে। আরে, আমার এই সাম্রাজ্য থেকে কেউ মুক্তি পায় না। মুক্তি একটাই— মৃত্যু।"
"যেমন আমার হতে চলেছে?" রাতুল জিজ্ঞেস করল।
"একদম," ঝা হাত বাড়াল। "দে।"
রাতুল লকেটটা তার হাতে দিল।
ঝা লকেটটা হাতে নিয়ে হাসল। "জানিস, তোকে মারার আগে তোর প্রশংসা করতে ইচ্ছে করছে। একটা সাধারণ অ্যাকাউন্টেন্ট হয়ে তুই যা করেছিস...। সান্যাল, শেষ করে দে এটাকে। এমনভাবে মারবি, যেন বডিটাও খুঁজে না পাওয়া যায়।"
সান্যাল তার সার্ভিস রিভলবারটা বের করে রাতুলের কপালে ঠেকালো। "খুব হিরো সেজেছিলি না? নে, এবার মর।"
রাতুল চোখ বন্ধ করল না। সে সান্যালের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। "একটা ভুল নম্বর... কত কিছু বদলে দিতে পারে, তাই না ইন্সপেক্টর?"
"কী বললি?"
"বললাম," রাতুল তার পকেট থেকে বাটন ফোনটা বের করে দেখাল। "সুব্রতদাকে মেসেজটা করা হলো না। আর ঠিক এক মিনিট পর... সকাল ছ'টা বাজবে।"
সান্যাল আর ঝা— দুজনেই চমকে উঠল। "কীসের ছ'টা?"
"টাইম-লকের," রাতুল বলল। "সারা দেশের মিডিয়া এখন আপনাদের এই কীর্তিগুলো লাইভ দেখবে।"
ঝা-এর মুখ থেকে চুরুটটা পড়ে গেল। "সান্যাল! গুলি কর! ফোনটা কাড়!"
সান্যাল ট্রিগারে চাপ দিতে গেল।
কিন্তু তার আগেই, ব্রিজের দু'দিক থেকে তীব্র হেডলাইটের আলো জ্বলে উঠল। গঙ্গার কুয়াশা চিরে প্রায় দশ-বারোটা পুলিশের জিপ আর মিডিয়ার ওবি ভ্যান হুড়মুড় করে এসে থামল।
"হ্যান্ডস আপ, মিস্টার ঝা! ইন্সপেক্টর সান্যাল, সারেন্ডার!"
রাতুল দেখল, জিপ থেকে নামছেন সুব্রত রায়। তার পেছনে সেই হলদে ট্যাক্সিটা। রিয়া আর মালবিকা কাঁদছেন, কিন্তু হাসছেন।
"সুব্রতদা! আপনি?" রাতুল অবাক।
"সরি ভাই," সুব্রতদা রাতুলকে জড়িয়ে ধরলেন। "তোকে একা ছাড়ার প্ল্যানটা আমার ছিল না। রিয়াদের ট্যাক্সিটাকেও আমরা ট্রেস করছিলাম। আর আমি টাইম-লক ছ'টায় সেট করিনি। আমি ওটা পাঁচটা পঞ্চান্নতেই সেট করেছিলাম। আর সেই ডেটা আমি শুধু মিডিয়াকে নয়, পুলিশের ডিসি (ক্রাইম)-কেও পাঠিয়েছি।"
অখিলেশ ঝা আর সান্যাল দেখল, ডিসি ক্রাইম নিজে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। পালানোর আর কোনো রাস্তা নেই।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion