শ্যামবাজার মোড়ে যখন বাসটা থামল, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে।
রাস্তার হলদে আলো জ্বলে উঠেছে। কিন্তু যে জায়গাটার দিকে রাতুল এগোচ্ছে, সেখানকার আলো-আঁধারি অনেক বেশি কুখ্যাত। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে সে যত এগোতে লাগল, পরিবেশটা ততই বদলাতে থাকল। চেনা কলকাতা যেন অচেনা হয়ে উঠছে। সরু গলি, পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান, সস্তা আতরের উগ্র গন্ধ, আর হাসাহাসির শব্দ।
রাতুল সেনগুপ্ত, যে লোকটা জীবনে কোনোদিন অফিসের ফাইল ছাড়া অন্য কিছুতে মাথা ঘামায়নি, সে দাঁড়িয়ে আছে সোনাগাছির মুখে।
বুকটা ঢিবঢিব করছিল। সে কি আদৌ ঠিক কাজ করছে? পুলিশ যেখানে পাত্তা দিল না, সেখানে সে একা কী করবে?
"পালিয়ে যাই," মনটা বলছিল।
"যদি মেয়েটা সত্যিই ওখানে থাকে?" বিবেকটা খোঁচা দিল।
সে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াল। দোকানদারকে আড়াল করে সে পকেট থেকে ফোনটা বের করল। "UNKNOWN NUMBER"। নম্বরটা এখনো সুইচড অফ।
"দাদা, একটা ঠিকানা খুঁজছিলাম," সে চায়ের অর্ডার দিয়ে 최대한 স্বাভাবিক গলায় বলল।
দোকানদার পান চিবোতে চিবোতে বলল, "কী ঠিকানা?"
"৮/বি... শুধু এইটুকুই জানি।"
দোকানদার তার আপাদমস্তক মেপে নিল। রাতুলের মতো সাধারণ, ভদ্রগোছের লোক এখানে 'ঠিকানা' খুঁজতে আসে না। তারা সরাসরি 'জায়গায়' যায়।
"কোন গলি? কার বাড়ি?"
"সেটা... সেটা জানি না। ৮/বি... একটা বাড়ি হবে হয়তো।"
দোকানদার তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। "এখানে সব বাড়িই 'বাড়ি' বাবু। তবে ৮/বি নামে এই তল্লাটে একটাই জায়গার নাম সবাই জানে। রুকসানা বেগমের কোঠি। লোকে '৮ নম্বর বাড়ি' বলেই চেনে। ওই যে, সামনের ওই নীল রঙের বাড়িটা, তার পরের গলি দিয়ে ঢুকে বাঁ হাতে।"
রাতুল চায়ের পয়সা মিটিয়ে দিয়ে সেদিকে এগোল।
গলিটা সরু। দু'পাশে গায়ে গা লাগিয়ে বাড়ি। মাথার ওপর তারের জটলা আকাশটাকে ঢেকে দিয়েছে। রাতুল একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। পুরোনো আমলের বাড়ি, রংচটা, কিন্তু দরজার ফ্রেমটা নতুন করে লাল-নীল রঙ করা। দরজার ওপর একটা ছোট, টিমটিমে বাল্বের নিচে একটা বিবর্ণ মেটালের প্লেট। তাতে অতিকষ্টে পড়া যায় — "৮/বি"।
দরজাটা বন্ধ। কিন্তু ভেতর থেকে চাপা হাসির আর উগ্র সঙ্গীতের আওয়াজ আসছিল।
রাতুল দরজার সামনে কয়েক মুহূর্ত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সে কী করবে? কলিং বেল বাজাবে? তারপর কী বলবে? "অনন্যা সেন নামে কেউ আছেন?"
সে বুঝতে পারছিল, এটা পাগলামি। সে সটান ভেতরে ঢুকে কাউকে খুঁজে বের করবে, এতটা সাহস বা ক্ষমতা তার নেই।
হঠাৎই দরজাটা ক্যাঁচ করে খুলে গেল। রাতুল চমকে দু'পা পিছিয়ে গেল।
ভেতর থেকে দু'জন লোক বেরিয়ে এল। দু'জনেই বেশ লম্বা-চওড়া, পেশিবহুল। তাদের মধ্যে একজন, যার মুখে একটা গভীর কাটার দাগ, সে রাতুলের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, "কী চাই?"
রাতুল আমতা আমতা করে বলল, "না... মানে... আমি..."
"এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? ভেতরে যাবি তো যা। না হলে রাস্তা মাপ।" লোকটা ওর মুখের ওপর একটা দশ টাকার নোট ছুঁড়ে দিল। "যা, চা খা গে যা। ফালতু ভিড় করবি না।"
রাতুল অপমানে সিঁটিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, তাকে দেখে ভিখারি বা ওই গোছের কিছু একটা ভেবেছে।
সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। প্রায় দৌড়ে গলিটা থেকে বেরিয়ে এল। বড় রাস্তায় এসে সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল। জামাটা ঘামে ভিজে গেছে।
ব্যর্থতা। চূড়ান্ত ব্যর্থতা। সে কিছুই করতে পারল না। পুলিশ ঠিকই বলেছিল, সে একজন সাধারণ ভীতু লোক।
সে ঠিক করল, বাড়ি ফিরে যাবে। অনেক হয়েছে।
ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে বড় রাস্তার দিকে এগোচ্ছিল। ৮/বি বাড়িটার ঠিক পাশেই একটা সরু গলি। সেটা বোধহয় বাড়িটার পেছনে যাওয়ার রাস্তা। সেদিকে চোখ পড়তেই সে থমকে দাঁড়াল।
গলিটার মুখে, আবর্জনার স্তূপের পাশে, একটা কিছু পড়ে আছে। চকচক করছে।
সাধারণত সে ওদিকে তাকাতোও না। কিন্তু আজ কী মনে হলো, সে সেদিকে এগোল।
ময়লার স্তূপের পাশে একটা ভাঙা মদের বোতল। আর তার পাশেই পড়ে আছে একটা ভায়োলেট রঙের ছোট পার্স। মেয়েদের পার্স। দামী চামড়ার।
রাতুল এদিক-ওদিক তাকাল। কেউ তাকে দেখছে না। সে চট করে পার্সটা তুলে নিল। ওটা ময়লা লাগেনি, মনে হচ্ছে কেউ ছুঁড়ে ফেলেছে।
সে দ্রুত পায়ে বড় রাস্তায় এসে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়ল।
বাসের সিটে বসে সে পার্সটা খুলল। ভেতরে কোনো টাকা নেই। একটা লিপস্টিক। আর একটা কার্ড।
রাতুল কার্ডটা বের করল।
ওটা একটা ক্লাবের মেম্বারশিপ কার্ড। "দ্য বেঙ্গল লাউঞ্জ"।
আর কার্ডের ওপর সোনালি অক্ষরে নাম লেখা— "অনন্যা সেন"।
রাতুল কার্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার হাত কাঁপছিল।
তাহলে... সে ঠিক জায়গায়ই এসেছিল। অনন্যা এখানে ছিল। তাকে এখান থেকেই সরানো হয়েছে। আর পালানোর সময় সে এই পার্সটা ফেলে দিয়েছে।
কিন্তু... সোনাগাছির একটা বাড়ি থেকে "দ্য বেঙ্গল লাউঞ্জ"-এর মতো একটা হাই-প্রোফাইল ক্লাবের কার্ড?
ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছিল, ততটা সহজ নয়। রাতুলের মনে হলো, সে অজান্তেই একটা গভীর ষড়যন্ত্রের প্রথম সুতোটা টেনে ধরেছে।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion