Episode 4806 words2 views

তৃতীয় অধ্যায়: দ্য বেঙ্গল লাউঞ্জ

পরদিন রাতুল অফিসে গেল না। সকালেই বসকে ফোন করে "তীব্র পেট খারাপের" অজুহাত দিল। তার সাধারণ, রুটিনমাফিক জীবনটা গত আটচল্লিশ ঘন্টায় ওলটপালট হয়ে গেছে। তার বেহালার এক কামরার ফ্ল্যাটে বসে সে কার্ডটা দেখছিল। "দ্য বেঙ্গল লাউঞ্জ"। সে ইন্টারনেটে সার্চ করল। যা ভেবেছিল তাই। পার্ক স্ট্রিটের অভিজাত এলাকায় অবস্থিত এই ক্লাব শহরের সবচেয়ে ধনী এবং প্রভাবশালী লোকেদের আড্ডাস্থল। সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। অনন্যা সেন মডেল। তার পক্ষে এই ক্লাবের সদস্য হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু তার পার্স সোনাগাছির এক কুখ্যাত কোঠির পেছনের আবর্জনা থেকে পাওয়া গেল কেন? রাতুল বুঝতে পারছিল, এই দুটো জায়গার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে, যেটা পুলিশও জানে না। আর সেই যোগসূত্রটাই এই কেসের চাবিকাঠি। কিন্তু সে কী করবে? সে আবার ইন্সপেক্টর সান্যালের কাছে যাবে? গিয়ে বলবে, "স্যার, আমি আপনার কথা না শুনে সোনাগাছি গিয়েছিলাম এবং এই পার্সটা পেয়েছি"? সান্যাল তাকে প্রথমেই জেরা করবে, সে ওখানে কেন গিয়েছিল। তারপর প্রমাণ লোপাটের দায়ে তাকেই হয়তো হাজতে পুরে দেবে। না। পুলিশের কাছে ফেরা যাবে না। রাতুল ঠিক করল, সে নিজেই "দ্য বেঙ্গল লাউঞ্জ"-এ যাবে। বিকেল চারটে। রাতুল তার সবচেয়ে ভালো জামাটা পরেছে— একটা চেক শার্ট আর ফর্ম্যাল ট্রাউজার্স। যা-ই হোক, তাকে অ্যাকাউন্টের ক্লার্কের মতোই দেখাচ্ছিল, অভিজাত ক্লাবের সদস্যের মতো নয়। ক্লাবের বাইরেটা ঝকঝকে। কাঁচের দরজা, উর্দি পরা দারোয়ান। রাতুল ইতস্তত করে দরজার দিকে এগোতেই একজন বিশালদেহী দারোয়ান তার পথ আটকাল। "কাঁহা?" "ভেতরে... মানে..." "মেম্বারশিপ কার্ড হ্যায়?" রাতুল পকেট থেকে অনন্যার কার্ডটা বের করে দেখাল। দারোয়ান কার্ডটা হাতে নিল। এক সেকেন্ড দেখেই সে রাতুলের দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে কোনো কিম্ভূত জীব দেখছে। "ইয়ে কার্ড আপকা হ্যায়?" (এই কার্ড আপনার?) "না... মানে, এটা আমার এক বন্ধুর..." দারোয়ান তাচ্ছিল্যের সাথে কার্ডটা ফেরত দিল। "ইয়ে লেডিজ কার্ড হ্যায়। অউর জিসকা কার্ড হ্যায়, উসকো হি আনা পড়েগা। আপ যাইয়ে।" (এটা মহিলার কার্ড। আর যার কার্ড, তাকেই আসতে হবে। আপনি যান।) রাতুল মিনতি করে বলল, "প্লিজ, আমি ম্যানেজারের সাথে একবার কথা বলতে চাই। খুব জরুরি।" "কোই ম্যানেজার আভি বাত নহি করেগা। আপ জাইয়ে। ভিড় মত্ লাগাইয়ে।" দারোয়ান তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। রাতুল বুঝল, এভাবে ভেতরে ঢোকা অসম্ভব। সে রাস্তার উল্টোদিকে একটা বেঞ্চে বসে ক্লাবটার দিকে নজর রাখতে লাগল। যদি সে ভেতরে ঢুকতেই না পারে, তাহলে সে কী করে জানবে এখানে কী হয়েছিল? প্রায় এক ঘন্টা কেটে গেল। সে দেখল, দামী দামী গাড়ি আসছে, লোক নামছে, ভেতরে যাচ্ছে। সে যেন এক অন্য জগতের বাইরে বসে আছে। "আপনিও ঢুকতে পারলেন না, তাই তো?" একটা মিষ্টি কিন্তু ধারালো গলার স্বর শুনে রাতুল চমকে পাশে তাকাল। একটি মেয়ে। বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। জিন্স-টপ পরা, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। রাতুল কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলল, "আমি রিয়া। রিয়া মিত্র। 'কলকাতার ক্রাইম' ওয়েব পোর্টালে কাজ করি। আপনি?" "রাতুল। রাতুল সেনগুপ্ত।" "তা রাতুলবাবু, এখানে কী করছিলেন? এই ক্লাবে তো আপনার-আমার মতো লোকের এন্ট্রি নেই।" রিয়া তার ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা জলের বোতল বের করে বসল। রাতুল ঠিক বুঝতে পারছিল না, মেয়েটাকে বিশ্বাস করা যায় কি না। রিয়া বলল, "আমি আন্দাজ করতে পারি। আপনি অনন্যা সেনের কেসটার ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছেন। তাই না?" রাতুল চমকে উঠল। "আপনি... আপনি কী করে জানলেন?" "কারণ আমিও সেটারই খোঁজ নিতে এসেছি।" রিয়ার হাসিটা মিলিয়ে গেল। "অনন্যা সেন নিখোঁজ হওয়ার আগে শেষ এই ক্লাবেই এসেছিল। তার ফোনের শেষ লোকেশনও এই ক্লাবের কাছেই পাওয়া গিয়েছিল। তারপর ফোন সুইচড অফ।" "পুলিশ তো বলল, শ্যামবাজার," রাতুল ফস করে বলে ফেলল। রিয়ার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে রাতুলের দিকে ঝুঁকে বসল। "এক্স্যাক্টলি! পুলিশ মিডিয়াকে শ্যামবাজারের লোকেশনটা বলেছে। কিন্তু আমার সোর্স বলছে, আসল লোকেশন ছিল পার্ক স্ট্রিট। পুলিশ কিছু একটা লুকাতে চাইছে, রাতুলবাবু।" রাতুল চুপ করে রইল। রিয়া বলল, "দেখুন, আমি জানি আপনি কিছু একটা জানেন। আপনি সাধারণ লোক, কিন্তু আপনি এখানে এসেছেন। তার মানে আপনার কাছে এমন কোনো খবর আছে, যা আমার কাছে নেই।" রাতুল দ্বিধা করছিল। সে একা। এই মেয়েটিও একা। হয়তো... সে পকেট থেকে অনন্যার কার্ডটা বের করল। "এটা কি যথেষ্ট খবর?" রিয়া কার্ডটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। "এটা... এটা আপনি কোথায় পেলেন? এটা তো অনন্যার কার্ড!" "সোনাগাছিতে। ৮/বি নম্বর বাড়ির পেছনের আবর্জনা থেকে।" রিয়ার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। "সোনাগাছি? আপনি সিরিয়াস?" রাতুল তাকে সংক্ষেপে সবটা বলল। রাতের ফোন কল, পুলিশের তাচ্ছিল্য, সোনাগাছিতে যাওয়া, পার্সটা পাওয়া— সবটা। রিয়া সবটা শুনে কয়েক মিনিট চুপ করে রইল। তারপর বলল, "রাতুলবাবু, আপনি বুঝতে পারছেন আপনি কীসের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছেন? সোনাগাছির ওই ৮/বি কোঠিটা হলো রুকসানা বেগমের। আর এই 'বেঙ্গল লাউঞ্জ'-এর মালিক হলো শহরের নামকরা প্রোমোটার অখিলেশ ঝা। লোকে বলে, ঝা সাহেবের পাওয়ার সাউথ ব্লকেও আছে।" "তাতে কী?" "তাতে এটাই," রিয়া উঠে দাঁড়াল, "যে রুকসানার কোঠি আর অখিলেশ ঝা-এর ক্লাবের মধ্যে কোনো একটা ভয়ংকর কানেকশন আছে। আর অনন্যা সেন সেই কানেকশনের শিকার।" রাতুলও উঠে দাঁড়াল। "এখন আমরা কী করব?" রিয়া তার চশমাটা ঠিক করল। তার চোখে একটা অদ্ভুত জেদ। "আপনি তো ভেতরে ঢুকতে পারলেন না। কিন্তু আমি পারব। আমার একটা প্ল্যান আছে। এই কার্ডটা আমার কাছেই রাখুন। কিন্তু আমার আপনার সাহায্য লাগবে।" "কী সাহায্য?" রাতুলের গলা শুকিয়ে আসছিল। "ভেতরে আমার এক সোর্স আছে। একজন ওয়েটার। নাম ভিকি। আমি ওকে খবর পাঠাচ্ছি। আজ রাতে ও আমাদের সাথে দেখা করবে। অখিলেশ ঝা-এর এই দুর্গে ঢোকার চাবি ওই ভিকির কাছেই আছে।"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion