Episode 5671 words2 views

চতুর্থ অধ্যায়: ভিকির বয়ান

রাত তখন ন'টা। পার্ক স্ট্রিটের ঝাঁ-চকচকে আলো থেকে কয়েক পা দূরেই একটা অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে গলি। রাস্তার গ্যাসবাতির আলো এখানে পৌঁছায় না। রিয়া এই জায়গাটাই বেছে নিয়েছে ভিকির সাথে দেখা করার জন্য। রাতুল দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকটা ধুকপুক করছে। তার মতো একজন ছাপোষা অ্যাকাউন্টেন্টের পক্ষে এই পরিবেশটাই অচেনা, ভয়ের। "রিয়া," সে ফিসফিস করে বলল, "ছেলেটা সত্যিই আসবে তো? যদি এটা কোনো ফাঁদ হয়?" রিয়া তার দিকে না তাকিয়েই বলল, "ভিকি টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। আর আমি ওকে ওর এক মাসের মাইনের ডবল অফার করেছি শুধু কথা বলার জন্য। ও আসবে।" ঠিক সেই মুহূর্তেই, গলির মুখ থেকে একটা ছায়ামূর্তি দ্রুত পায়ে এগিয়ে এল। পরনে 'দ্য বেঙ্গল লাউঞ্জ'-এর কালো ইউনিফর্ম। ছেলেটা রোগা, বয়স কুড়ি-বাইশের বেশি নয়। "ম্যাডাম," ভিকি নামের ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, "আমি পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারব না। আমার ডিউটি চলছে। ধরা পড়লে ঝা-সাহেব আমাকে আস্ত পুঁতে ফেলবে।" "শান্ত হও ভিকি," রিয়া তার ব্যাগে হাতড়ে একটা খাম বের করল। "এই নাও তোমার টাকা। এবার বলো। সেই রাতে কী হয়েছিল? অনন্যা সেন।" ভিকি খামটা নিয়ে দ্রুত পকেটে পুরল। তারপর ঢোঁক গিলে চারপাশটা দেখে নিল। "হ্যাঁ ম্যাডাম। অনন্যা ম্যাডাম সেই রাতে ক্লাবে এসেছিলেন। রাত দশটা নাগাদ।" "একা?" রিয়া জিজ্ঞেস করল। "না।" ভিকির গলাটা ভয়ে কাঁপছিল। "উনি ঝা-সাহেবের (অখিলেশ ঝা) সাথেই এসেছিলেন। সাথে আরও একজন লোক ছিল। আমি চিনি না, কিন্তু দারোয়ানরা বলাবলি করছিল যে লোকটা নাকি কোনো বড় নেতা।" রাতুল আর রিয়া একে অপরের দিকে তাকাল। ভিকি বলে চলল, "ওদেরকে প্রাইভেট ডাইনিং রুম 'পি-ডি-আর'-এ নিয়ে যাওয়া হয়। আমি ওই ফ্লোরেই ডিউটিতে ছিলাম। রাত বারোটা নাগাদ ভেতর থেকে প্রচণ্ড চেঁচামেচির আওয়াজ পাই।" "কীসের চেঁচামেচি?" রাতুল জিজ্ঞেস করল। "অনন্যা ম্যাডাম চিৎকার করছিলেন। বলছিলেন, 'আমাকে যেতে দাও! আমি সব ফাঁস করে দেব!' আর ঝা-সাহেব বলছিলেন, 'তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। যা পেয়েছিস, সেটা এক্ষুনি দিয়ে দে, না হলে ভালো হবে না।'" "কী... কী চাইছিল?" "একটা পেন ড্রাইভ," ভিকি বলল। "ম্যাডাম বলছিলেন, 'পেন ড্রাইভ আমার কাছে নেই। ওটা আমি সেফ জায়গায় রেখে দিয়েছি। আমার কিছু হলে ওটা মিডিয়ার কাছে চলে যাবে।' এই নিয়েই ঝগড়া। তারপর..." ভিকির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। "তারপর কী, ভিকি?" রিয়া ওর হাতটা চেপে ধরল। "ম্যাডাম ঘর থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে দৌড় দেন। কিন্তু ঝা-সাহেবের লোক, ওই যে কালাম... যার মুখে কাটার দাগ... সে ম্যাডামকে ধরে ফেলে। ম্যাডামের মুখে একটা রুমাল চেপে ধরে। ম্যাডাম ওখানেই নেতিয়ে পড়েন।" রাতুল শিউরে উঠল। কালাম! এই লোকটাকেই সে ৮/বি-এর দরজায় দেখেছিল। "ওরা ম্যাডামকে মেন গেট দিয়ে বের করেনি," ভিকি বলল। "ওরা সার্ভিস লিফট দিয়ে ম্যাডামকে বেসমেন্টে নামায়। তারপর পেছনের সার্ভিস এক্সিট দিয়ে বের করে একটা কালো এস.ইউ.ভি-তে তুলে নেয়। আমি জানলা দিয়ে দেখেছি।" "গাড়িটা কোন দিকে গেল?" "শ্যামবাজারের দিকে ম্যাডাম। ঝা-সাহেবের সব 'ডার্টি ওয়ার্ক' ওদিকেই হয়। রুকসানা বেগমের কোঠি..." রাতুল আর রিয়ার কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল। পুলিশ কেন শ্যামবাজারের লোকেশন বলছিল, সেটাও স্পষ্ট। অখিলেশ ঝা নিজেই পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সে মিডিয়াকে ভুল পথে চালিত করার জন্য শ্যামবাজারের নামটা ব্যবহার করেছে, কিন্তু এটা বলেনি যে অনন্যাকে সোনাগাছিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। "ভিকি, ওই পেন ড্রাইভে কী আছে তুমি কিছু জানো?" রিয়া জিজ্ঞেস করল। "না ম্যাডাম। কিন্তু ঝা-সাহেব যেভাবে ক্ষেপে উঠেছিলেন, তাতে মনে হয় ওটা ওঁর কফিনের চাবিকাঠি।" ভিকি হঠাৎ চমকে উঠে বলল, "আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাই।" "এক সেকেন্ড!" রাতুল ওকে থামাল। "অনন্যা... মানে ওই মহিলা কি বাঁচার কোনো চেষ্টা করেননি? কাউকে ফোন..." "করেছিলেন!" ভিকি বলল। "কালাম যখন ওঁর হাত ধরে টানছিল, তখন ওঁর পার্সটা মেঝেতে পড়ে যায়। ফোনটা ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ম্যাডাম কোনোমতে ফোনটা হাতে নিয়ে একটা নম্বর ডায়াল করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কালাম ফোনটা কেড়ে নিয়ে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে। তারপর..." ভিকি আর দাঁড়াল না। "আমি কিছু দেখিনি, কিছু বলিনি, ম্যাডাম। আমাকে বাঁচান," বলতে বলতে সে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। রাতুল দেওয়ালে হেলান দিল। তার পা কাঁপছিল। তাহলে ওই ফোনটা... ওই "UNKNOWN NUMBER"... ওটা ছিল অনন্যার শেষ চেষ্টা। সে হয়তো কোনোক্রমে নম্বরটা ডায়াল করতে পেরেছিল, কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই... "রাতুলবাবু," রিয়া ওর কাঁধে হাত রাখল। "এবার বুঝতে পারছেন, আমরা কীসের মোকাবিলা করছি? এটা শুধু একটা কিডন্যাপিং নয়। এটা একটা হাই-প্রোফাইল মাডার অ্যাটেম্পট। আর এর পেছনে অখিলেশ ঝা নিজে আছে।" "এখন কী হবে?" রাতুলের গলা শুকিয়ে কাঠ। "এখন আমাদের ওই পেন ড্রাইভটা খুঁজে বের করতে হবে। ওটাই অনন্যাকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়। আর ঝা-কে ধরারও। চলুন, আপনার বাড়ি যাই। এখানে থাকা আর সেফ নয়।"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion