বেহালার ফ্ল্যাটে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় এগারোটা।
রাতুল দরজা বন্ধ করে বসার ঘরের আলোটা জ্বালল। তার এই ছোট্ট, ছিমছাম ঘরটাকেও আজ কেমন যেন অচেনা লাগছিল। রিয়ার জন্য সে এক গ্লাস জল আনল।
"সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে, রিয়া," রাতুল সোফায় ধপ করে বসে বলল। "আমি একজন সাধারণ অ্যাকাউন্টেন্ট। ডেবিট-ক্রেডিট আমার কাজ। আমি এই খুনি, মাফিয়া, পেন ড্রাইভ... এসবের মধ্যে কী করে ফেঁসে গেলাম!"
রিয়া জলটা এক চুমুকে শেষ করল। "আপনি ফেঁসে যাননি, রাতুলবাবু। আপনি জড়িয়ে পড়েছেন। ঠিক যেমন আমি। আমার কাজ খবর খোঁজা। কিন্তু এই কেসটা... এটা আমারও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।"
সে তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট নোটপ্যাড বের করল। "অখিলেশ ঝা। প্রোমোটার। কিন্তু সবাই জানে ওর আসল ব্যবসা ব্ল্যাকমেলিং আর হিউম্যান ট্র্যাফিকিং। রুকসানা বেগমের কোঠি ওর একটা সেফ হাউস। নতুন মেয়েদের, বিশেষ করে যারা হাই-সোসাইটির, তাদের এনে ওখানে আটকে রাখা হয়। তারপর তাদের দিয়ে বড় বড় লোকেদের ব্ল্যাকমেল করা হয়।"
"অনন্যাও কি সেই ফাঁদে..."
"হয়তো। হয়তো অনন্যা কিছু একটা জেনে ফেলেছিল। সেই তথ্যই ওই পেন ড্রাইভে ছিল। সে হয়তো ঝা-কে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল, বা ওর থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। আর তাতেই সব গন্ডগোল হয়ে গেল।"
রাতুল শিউরে উঠল। "তাহলে কি অনন্যা এখনো বেঁচে আছে?"
"জানি না," রিয়ার স্বরটা গম্ভীর। "ঝা-এর লোক তাকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেছে। ওই পার্সটা আপনি ওখান থেকে পেয়েছেন। তার মানে, অনন্যা হয়তো পালানোর চেষ্টা করেছিল। আর তখনই সে আপনাকে ফোনটা করে।"
"কিন্তু ও আমার নম্বর পেল কী করে?" রাতুল বলল। "ও তো আমাকে চেনে না।"
"হয়তো র্যান্ডমলি ডায়াল করেছিল," রিয়া বলল। "অথবা... হয়তো আপনার নম্বরটা ওর ফোনে সেভ ছিল। অন্য কোনো নামে।"
"অসম্ভব! আমি ওকে চিনি না।"
"ভাবুন রাতুলবাবু। ভালো করে ভাবুন। আপনার অফিসের সাথে কি ঝা-এর কোনো..."
কথাটা শেষ হলো না।
ঠিক সেই মুহূর্তে, দরজায় কেউ কড়া নাড়ল।
ঠক্। ঠক্। ঠক্।
এত রাতে? রাতুল আর রিয়া দু'জনেই চমকে উঠে দাঁড়াল।
"কে?" রাতুল জিজ্ঞেস করল।
বাইরে থেকে কোনো উত্তর এল না। শুধু গলির কুকরগুলো হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
রিয়া ইশারায় রাতুলকে চুপ করতে বলল। সে নিজে নিঃশব্দে দরজার 'পিপ-হোল'-এর দিকে এগোল।
বাইরে তাকিয়েই সে পাথরের মতো জমে গেল। তার মুখ থেকে সব রক্ত সরে গেছে।
সে পিছিয়ে এসে ফিসফিস করে রাতুলকে বলল, "পুলিশ।"
"পুলিশ?" রাতুল অবাক হলো। "তাহলে দরজা খুলছেন না কেন?"
"এটা সেই পুলিশ নয়," রিয়ার গলা কাঁপছিল। "ইন্সপেক্টর অরূপ সান্যাল। যার কাছে আপনি প্রথম গিয়েছিলেন। উনি একা নন। ওঁর সাথে কালাম আছে।"
রাতুল কিছুই বুঝতে পারছিল না। "কালাম? ঝা-এর লোক? পুলিশের সাথে?"
"সান্যাল 'ইনফর্মার' নয়, রাতুলবাবু," রিয়া আতঙ্কিত গলায় বলল। "সান্যাল ঝা-এর লোক। ও 'ডিপার্টমেন্ট'-এ ঝা-এর হয়ে কাজ করে। আমরা যে ভিকির সাথে দেখা করেছি, সেই খবর ওরা পেয়ে গেছে। ওরা আমাদের ধরতে এসেছে। সব প্রমাণ লোপাট করার জন্য।"
আবার দরজায় ধাক্কা পড়ল। এবার অনেক জোরে।
"দরজা খুলুন, মিস্টার সেনগুপ্ত! আমরা জানি আপনারা ভেতরেই আছেন!"
এটা সান্যালের গলা।
রাতুল আর রিয়ার পালানোর সব পথ বন্ধ। এটা একতলার ফ্ল্যাট।
"পেছনের জানলা!" রিয়া চেঁচিয়ে উঠল। "রান্নাঘরের।"
রাতুল রান্নাঘরের দিকে দৌড়ল। একটাই ছোট জানলা। তার বাইরে একটা সরু গলি।
রাতুল সবে জানলাটা খুলতে যাচ্ছে, এমন সময় সে বাইরে একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। জানলার ঠিক ওপাশেই একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার হাতের সিগারেটটা জ্বলজ্বল করছে।
ওরা ফ্ল্যাটটাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।
ঘরের ভেতর রাতুল আর রিয়া। আর বাইরে, অখিলেশ ঝা-এর খুনি আর দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ।
দরজায় এবার লাথির শব্দ শোনা গেল। "দরজা ভাঙো!"
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion