Episode 7668 words2 views

ষষ্ঠ অধ্যায়: অন্ধকারের মধ্যে পালানো

"দরজা ভাঙো!" বাইরে থেকে ইন্সপেক্টর সান্যালের হুঙ্কার ভেসে আসছিল। আর তার সাথে সাথেই দরজার ওপরে পড়ল একটা প্রচণ্ড লাথির শব্দ। কাঠ ফাটবার আওয়াজ হলো। রাতুল ভয়ে জমে গেছে। তার মনে হচ্ছে তার পা দুটো মেঝের সাথে আটকে গেছে। সে একজন অ্যাকাউন্টেন্ট, এই পরিস্থিতির জন্য সে বিন্দুমাত্র প্রস্তুত নয়। "রাতুলবাবু! এদিকে!" রিয়ার চিৎকার তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল। রিয়া রান্নাঘরে ছিল না। সে দৌড়ে গিয়েছিল ঘরের কোণে রাখা বাথরুমের দিকে। বাথরুমটা ছোট, স্যাঁতসেঁতে। তার ভেতরে একটা মাত্র ভেন্টিলেটর। রিয়া কমোডের ওপর দাঁড়িয়ে সেই ভেন্টিলেটরের পাল্লাটা খোলার চেষ্টা করছিল। "রান্নাঘরের জানলায় লোক আছে, কিন্তু এটা পেছনের সরু পচা গলিটার দিকে খোলে। ওরা হয়তো এদিকে খেয়াল রাখেনি!" ঠিক সেই মুহূর্তে, বসার ঘরের দরজাটা সশব্দে ভেঙে পড়ল। "কোথায় গেল ওরা?" কালামের কর্কশ গলা। "রান্নাঘরের জানলা খোলা! ওদিক দিয়ে পালিয়েছে! ধর!" সান্যাল চেঁচিয়ে উঠল। রাতুল দেখল, দুটো ছায়ামূর্তি রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গেল। "এক্ষুনি!" রিয়া চেঁচাল। কিন্তু রাতুল এক ঝটকায় রিয়ার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তার মস্তিষ্ক হঠাৎ করেই যেন কাজ করা শুরু করেছে। এই প্রথমবার, ভয়ের বদলে তার মধ্যে একটা অদ্ভুত জেদ কাজ করল। "আপনি আগে যান!" সে রিয়াকে প্রায় ঠেলে বাথরুমের দিকে পাঠাল। "আমি আসছি!" "পাগলামি করবেন না!" "যা বলছি করুন!" রিয়া আর এক মুহূর্তও নষ্ট করল না। সে ভেন্টিলেটর দিয়ে অর্ধেক শরীর গলিয়ে দিয়েছে। রাতুল তার টেবিলের দিকে দৌড়ল। ড্রেসিং টেবিলে রাখা ডিওডোরেন্টের ক্যানটা সে খপ করে তুলে নিল। পকেট থেকে লাইটারটা বের করল। সে দেখল, সান্যাল আর কালাম রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মারছে। "কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো!" "এখানে!" রাতুল তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। সান্যাল আর কালাম চমকে ঘুরে তাকাল। রাতুল ওদের দিকে তাকিয়ে লাইটারটা জ্বেলে ডিওডোরেন্টের ক্যান থেকে স্প্রে করল। "হুশশশ!" একটা ছোটখাটো আগুনের গোলা তৈরি হলো। সেটা সান্যাল বা কালামের গায়ে লাগল না, কিন্তু তার প্রচণ্ড তাপে আর আলোয় দুজনেরই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। "আআআ!" কালাম চোখে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। "আগুন!" সান্যাল পেছনে সরতে গিয়ে টেবিলের ওপর পড়ে গেল। এই এক মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল। রাতুল এক লাফে বাথরুমে ঢুকে দরজাটা লক করে দিল। রিয়া ততক্ষণে ভেন্টিলেটর গলে বাইরে নেমে পড়েছে। "তাড়াতাড়ি!" রাতুল কোনোমতে ভেন্টিলেটর দিয়ে শরীরটা গলিয়ে দিল। এটা একতলার ফ্ল্যাট, তাই গলিটা খুব বেশি নীচে নয়। সে একটা নোংরা আবর্জনার স্তূপের ওপর ধপাস করে পড়ল। "পালাও!" রিয়া তার হাত ধরে টানল। ভেতরে সান্যাল বাথরুমের দরজায় লাথি মারতে শুরু করেছে। "বদমাশ! ধর ওকে!" রাতুল আর রিয়া সেই অন্ধকার, দুর্গন্ধময় গলি দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। রাতুলের পা মচকে গেল, রিয়ার কনুইটা দেওয়ালে ঘষে গিয়ে ছড়ে গেল। কিন্তু তারা থামল না। পেছনের বাড়ি থেকে তারা শুনতে পাচ্ছিল সান্যালের চিৎকার, "গলিটা ঘিরে ফেল! গাড়িটা ওদিকে নিয়ে আয়!" ওরা জানে না ওরা কোথায় যাচ্ছে। শুধু দৌড়োচ্ছে। বেহালার এই গলি-তস্য গলি তাদের চেনা নয়। একটা পুলিশ জিপের সাইরেন শোনা গেল। "এদিকে!" রিয়া একটা আধা-নির্মাণ বাড়ির পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ল। রাতুলও তাকে অনুসরণ করল। ওরা একটা ইঁট-বালি-সিমেন্টের স্তূপের পেছনে লুকিয়ে পড়ল। হাঁপাচ্ছে দুজনেই। রাতুলের জামাটা ছিঁড়ে গেছে। রিয়ার চশমাটা কোথায় যেন পড়ে গেছে। বাইরে জিপের আলো এসে পড়ল। ওরা কথা বলার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। "শালা, পাখি উড়ে গেছে।" কালামের গলা। "চিন্তা করিস না সান্যাল-দা। যাবে আর কোথায়? পুরো শহর লক করে দেব। ঝা-সাহেবকে খবরটা দে।" গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। জিপটা গর্জন করে চলে গেল। বহুক্ষণ, প্রায় আধ ঘণ্টা, ওরা ওভাবেই বসে রইল। নিস্তব্ধ। শুধু রাতুলের হৃৎপিণ্ডটা এমনভাবে লাফাচ্ছিল, যেন মনে হচ্ছে বুক ফেটে বেরিয়ে আসবে। "আমরা... বেঁচে গেছি," রাতুল ফিসফিস করে বলল। রিয়া অন্ধকারেও হাসার চেষ্টা করল। "আপাতত। কিন্তু এখন আমরা ফেরারি আসামী। আপনার ওই এক কামরার ফ্ল্যাটটা ছিল আমাদের শেষ নিরাপদ জায়গা। সেটাও গেল।" রাতুল তার ছেঁড়া জামার দিকে তাকাল। তার সাজানো, একঘেয়ে জীবনটা এই আবর্জনার স্তূপের মতোই ভেঙেচুরে পড়ে আছে। "এখন কী হবে?" রাতুল জিজ্ঞেস করল। "এখন আসল খেলা শুরু," রিয়া উঠে দাঁড়াল। "সান্যাল জানে আমরা কী জানি। ঝা জানে আমরা তার পেছনে পড়েছি। ওরা আমাদের খুঁজে বের করার আগেই, আমাদের ওই পেন ড্রাইভটা খুঁজে বের করতে হবে।" "কোথায় পাব ওটা?" "ভিকি বলেছিল, অনন্যা বলেছে ওটা 'সেফ জায়গায়' আছে। আর ওর কিছু হলে ওটা মিডিয়ার কাছে চলে যাবে," রিয়া বলল। "তার মানে, ওটা এমন কারোর কাছে আছে, যাকে অনন্যা নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করত।" "কে সে?" "জানি না," রিয়া বলল। "কিন্তু সেটা খুঁজে বের করার জন্য আমাদের এমন একজনের সাহায্য লাগবে, যাকে পুলিশ বা ঝা, কেউই সন্দেহ করবে না।"

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion