Episode 8618 words2 views

সপ্তম অধ্যায়: ছায়ামানব

পরদিন ভোর হলো একটা নোংরা, নির্মীয়মাণ বাড়ির ছাদে। রাতুল আর রিয়া সারারাত জেগেই কাটিয়েছে। ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই রিয়া বলল, "আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে। দিনের আলোয় ওরা আমাদের ঠিক খুঁজে নেবে।" "কিন্তু আমরা যাব কোথায়?" রাতুলের গলায় হতাশা। "আমাদের কাছে টাকা নেই, ফোন নেই।" রিয়া তার জিন্সের পকেট থেকে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া একটা একশ টাকার নোট বের করল। "এটা আছে। আর আমার ফোনটা আমার ব্যাগে আছে, কিন্তু ওটা অন করা মানে সান্যালকে ডেকে আনা। ফোন ট্র্যাকেবল।" "তাহলে?" "আমার একজন পরিচিত আছে," রিয়া বলল। "আমার পুরোনো এডিটর। সুব্রতদা। ওঁর একটা ছোট নিউজ পোর্টাল আছে। 'কলকাতার আয়না'। সুব্রতদা ছাড়া এই শহরে আর কেউ নেই যে অখিলেশ ঝা-এর বিরুদ্ধে একটা শব্দও ছাপার সাহস রাখে।" "তিনি আমাদের সাহায্য করবেন?" "যদি ওঁর কাছে গিয়ে পৌঁছাতে পারি," রিয়া বলল। "চলুন।" ওরা পাঁচিল টপকে বেরোল। রিয়া একটা সস্তা ওড়না দিয়ে মাথা-মুখ ঢেকে নিল। রাতুল একটা ভাঙা দোকানের সামনে থেকে একটা পুরোনো খবরের কাগজ তুলে নিল, সেটা দিয়েই সে মুখটা আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল। দুজনে দুটো আলাদা রিকশা নিল। তারপর লোকাল বাস। বাসেও তারা এমনভাবে দাঁড়াল যেন কেউ কাউকে চেনে না। প্রতিটা মোড়ে পুলিশের গাড়ি দেখলেই ওদের বুকটা ছ্যাঁত করে উঠছিল। দুপুর নাগাদ ওরা ধর্মতলার একটা পুরোনো, জীর্ণ বিল্ডিং-এর সামনে এসে দাঁড়াল। "কলকাতার আয়না"-এর অফিস। সুব্রত রায় একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব, কাঁচাপাকা চুল-দাড়ির লোক। রিয়ার এই অবস্থা দেখে তিনি চমকে উঠলেন। "রিয়া! তোর এই হাল কে করেছে?" "ভেতরে চলুন দাদা। সব বলছি।" অফিসের ছোট কেবিনে বসে রিয়া আর রাতুল সবটা খুলে বলল। প্রথম ফোন কল থেকে শুরু করে গত রাতের পালানোর ঘটনা পর্যন্ত। সুব্রত রায় সবটা শুনলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে বললেন, "অখিলেশ ঝা। তুই এমন একটা সাপের ল্যাজে পা দিয়েছিস, রিয়া, যেটার মাথাটা খোদ রাইটার্স-এ বসে আছে।" "আমি জানি দাদা। কিন্তু অনন্যা সেন নামের ওই মডেল... সে এখনও হয়তো বেঁচে আছে। আর আমাদের কাছে ওই পেন ড্রাইভটা ছাড়া আর কোনো প্রমাণ নেই।" "সুব্রতদা," রাতুল এই প্রথম কথা বলল। "আমার একটা কথা কিছুতেই মিলছে না। অনন্যা সেন আমাকে ফোন করল কেন? সে আমার নম্বর পেল কী করে? আমি তো তাকে চিনি না।" রিয়া বলল, "ভিকি বলেছিল, অনন্যা হয়তো কোনোক্রমে একটা নম্বর ডায়াল করেছিল..." "না," রাতুল মাথা নাড়ল। "আমার তা মনে হয় না। এটা র্যান্ডম কল হতে পারে না। আচ্ছা, রিয়া, আপনি বললেন অনন্যা হাই-সোসাইটিতে মিশত?" "হ্যাঁ। মডেলিং করত। বড় বড় ক্লায়েন্ট..." "ক্লায়েন্ট!" রাতুল প্রায় লাফিয়ে উঠল। "আমার অফিস! আমি যে ফার্মে কাজ করি, তারা অনেক ছোট ছোট কোম্পানির অ্যাকাউন্টস দেখে। আমাদের একটা ক্লায়েন্ট আছে... 'স্টারলাইট মিডিয়া'। একটা পি.আর. এজেন্সি।" সুব্রতদা তার কম্পিউটারে খটখট করে টাইপ করলেন। "স্টারলাইট মিডিয়া। হ্যাঁ, আছে।" "আমার মনে পড়ছে," রাতুল উত্তেজিত হয়ে বলল, "কয়েক মাস আগে অডিটের সময় আমি এই নামটা দেখেছিলাম। অনন্যা সেন! স্টারলাইট মিডিয়া অনন্যা সেনের পোর্টফোলিও ম্যানেজ করত। আর আমাদের কোম্পানি ওদের ট্যাক্স ফাইল করত। সেই ফাইলেই আমার নাম আর ফোন নম্বর ছিল! এজেন্সির কন্ট্যাক্ট পার্সন হিসেবে!" রিয়া আর সুব্রতদা একে অপরের দিকে তাকাল। "তার মানে," রিয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, "অনন্যা আপনাকে চিনত! সে জানত আপনি একজন সাধারণ অ্যাকাউন্টেন্ট। তাই সে পুলিশ বা মিডিয়াকে ফোন না করে আপনাকে ফোন করেছিল। সে ভেবেছিল, পুলিশ বা মিডিয়া সবাই ঝা-এর লোক হতে পারে, কিন্তু একজন সাধারণ নিরীহ অ্যাকাউন্টেন্টকে কেউ সন্দেহ করবে না!" রাতুল বিড়বিড় করল, "ওটা 'ভুল নম্বর' ছিল না। ওটা ছিল একমাত্র 'সঠিক নম্বর'।" সুব্রতদা কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তোমরা ঠিকই ধরেছ। কিন্তু তোমরা একটা জিনিস মিস করছ।" "কী?" সুব্রতদা মনিটরটা ওদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। একটা খবর। "মডেল অনন্যা সেনের নিখোঁজ রহস্যে নতুন মোড়। পুলিশি তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগে পুলিশ অনন্যা সেনের এক 'বিশেষ বন্ধু'-কে খুঁজছে।" খবরের নিচে একটা স্কেচ। রাতুল দেখল, ওটা তার মুখের স্কেচ। পুলিশ নিশ্চয়ই রাতুলের অফিসের কলিগদের থেকে তার চেহারার বর্ণনা নিয়ে ওটা বানিয়েছে। "ওরা আপনাকে 'বিশেষ বন্ধু' বানিয়ে দিয়েছে, রাতুলবাবু," রিয়া বলল। "ওরা মিডিয়াকে বুঝিয়েছে, আপনিই অনন্যাকে নিয়ে পালিয়েছেন। হয়তো আপনিই ওকে খুন করেছেন।" রাতুল দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে পড়ল। সে এখন শুধু একজন ফেরারি আসামী নয়। সে এখন গোটা শহরের চোখে একজন সন্দেহভাজন খুনি।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion