পরের দিন ভোর হওয়ার আগেই ভবতোষের ঘুম ভেঙে গেল। মনোহর ওস্তাদের শোকাতুর অথচ ভয়ঙ্কর মুখটা তাঁর চোখের সামনে ভাসছিল। একজন শোকার্ত পিতা আর একজন ভয়ঙ্কর তান্ত্রিক—এই দুই সত্তার মধ্যে বিভেদটা বড় সূক্ষ্ম। ভবতোষ বুঝতে পারছিলেন, সরাসরি সংঘাতে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মনোহর শুধু একজন দক্ষ ছায়াবাজিকরই নয়, তার ইচ্ছাশক্তিও প্রবল। তাকে থামাতে হলে তার দুর্বলতাকে জানতে হবে, তার শক্তির উৎসকে খুঁজে বের করতে হবে।
সকালের প্রথম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তিনি শরৎকে ডেকে পাঠালেন। শরৎ আসতেই তিনি বললেন, “শরৎ, তোমার সাংবাদিকতার বুদ্ধি আর যোগাযোগকে এবার কাজে লাগাতে হবে। আমাকে এই মনোহর ওস্তাদ সম্পর্কে সব তথ্য এনে দিতে হবে। সে কোথা থেকে এসেছে, তার অতীত কী, তার মেয়ের ব্যাপারটাই বা কী—সব।”
শরৎ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “লোকটা তো কারও সাথে কথাই বলে না। তথ্য পাব কোথা থেকে?”
“তার দলের তো অন্য লোক আছে,” ভবতোষ বললেন। “যারা বাদ্যযন্ত্র বাজায়, মঞ্চ সাজায়। তাদের মুখ থেকে কিছু বের করা যায় না? আর সে নিশ্চয়ই আকাশ থেকে পড়েনি। কোনো গ্রাম, কোনো শহর তো তার শিকড় আছে। খোঁজ লাগাও। বিশেষ করে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার দিকে খোঁজটা বেশি করে চালাবে। ওদিকের লোকশিল্পীদের মধ্যে এখনও অনেক গুপ্ত সাধনার চল আছে।”
শরৎ কথা দিল সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবে।
শরৎ বেরিয়ে যেতেই ভবতোষ তাঁর পূজার ঘরে প্রবেশ করলেন। দেরাজ খুলে ধুলোমাখা পুঁথির স্তূপ থেকে একটি পুঁথি বের করলেন, যার মলাটটা প্রায় ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। পুঁথিটির নাম ‘ছায়া-দর্পণিকা’। এটি ছায়াতন্ত্রের একটি প্রতিষেধক গ্রন্থ। এতে ছায়াকে রক্ষা করার এবং অপহৃত ছায়াকে ফিরিয়ে আনার বিভিন্ন পদ্ধতির বর্ণনা ছিল।
ভবতোষ পাতা ওল্টাতে লাগলেন। মনোহর যে পদ্ধতিতে ছায়া শোষণ করছে, তা প্রতিহত করার একটিই উপায় লেখা আছে—’কায়া-বন্ধন’। এর জন্য প্রয়োজন একটি বিশেষ আয়না, যা সাধারণ পারদ দিয়ে তৈরি নয়। এই আয়না তৈরি হবে অষ্টধাতুর মিশ্রণে এবং তাকে শোধন করতে হবে অমাবস্যার রাতে শ্মশানের বুকে, ‘মহাকালী’ মন্ত্রে। এই আয়নাকে বলা হয় ‘ছায়া-দর্পণ’। এই দর্পণ শুধু ছায়াকে প্রতিফলিত করে না, ছায়াকে আকর্ষণ করার শক্তিকেও উল্টো দিকে চালিত করতে পারে। যদি মনোহরের ক্রিয়ার সময় এই দর্পণ তার সামনে ধরা যায়, তবে তার সমস্ত শক্তি তারই দিকে ফিরে যাবে এবং তার নিজের ছায়াই তার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবে।
কিন্তু এই দর্পণ তৈরি করা সহজ নয়। অষ্টধাতু জোগাড় করা গেলেও, তাকে শোধন করার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। ভবতোষ তাঁর পুরনো এক পরিচিত স্বর্ণকারের সাহায্যে অষ্টধাতু জোগাড় করে একটি ছোট, গোল দর্পণ গড়িয়ে নিলেন। কিন্তু আসল কাজটা ছিল এরপর। পুঁথির নির্দেশ অনুযায়ী, অমাবস্যার আগের সাতটি রাত ধরে সেই দর্পণটিকে নিজের সামনে রেখে বিশেষ মন্ত্র জপ করতে হবে, যাতে সাধকের নিজস্ব প্রাণশক্তি দর্পণের সাথে একাত্ম হতে পারে। সাধককে নিজের সমস্ত মানসিক শক্তি কেন্দ্রীভূত করে কাজটি করতে হয়, সামান্যতম বিচ্যুতি ঘটলে তার নিজের প্রাণ সংশয় হতে পারে।
দিন তিনেক পর, প্রায় মধ্যরাতে, শরতের আবির্ভাব হলো। তার চোখেমুখে উত্তেজনার আর ক্লান্তির ছাপ। সে ভবতোষের সামনে একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে বলল, “খবর আছে, ভবতোষ। অনেক কষ্টে বের করেছি।”
ভবতোষ উৎসুক চোখে তাকালেন।
শরৎ বলতে শুরু করল, “তোমার কথাই ঠিক। লোকটার আসল নাম মনোহর সূত্রধর। বাড়ি বাঁকুড়ার এক ছোট গ্রামে, নাম বিষ্ণুপুর। সে ছিল তার অঞ্চলের সেরা পুতুলশিল্পী। তার তৈরি কাঠের পুতুল এতটাই জীবন্ত ছিল যে, লোকে বলত সে নাকি কাঠে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তার একটিই মেয়ে ছিল, নাম মায়া। মেয়েটি ছিল তার জগৎ। বছর পাঁচেক আগে, সাপের কামড়ে মেয়েটি মারা যায়।”
শরৎ একটু থেমে দম নিল। “গ্রামের লোক বলে, মেয়ের মৃত্যুর পর থেকেই মনোহর কেমন যেন হয়ে যায়। সে মেয়ের সৎকার করতে দেয়নি। দেহটা আগলে রেখে বিড়বিড় করে কীসব বলত। তারপর একদিন রাতের অন্ধকারে মেয়ের দেহ নিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আর তার সাথে নিয়ে যায় তার সেরা পুতুলগুলো।”
ভবতোষের কাছে এবার ছবিটা স্পষ্ট হয়ে গেল। মনোহর তার মেয়ের দেহ এখনও আগলে রেখেছে। হয়তো কোনো রাসায়নিক বা তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সেটিকে পচনের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর সেই দেহেই সে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
শরৎ আরও বলল, “তার দলের একজন লোকের সাথে কথা বলতে পেরেছি। লোকটা ভয়ে কাঁপছিল। অনেক চেষ্টার পর, কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে সে মুখ খুলেছে। মনোহর নাকি নাটমন্দিরের নীচের এক গোপন কুঠুরিতে থাকে। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেয় না। গভীর রাতে সেখান থেকে নাকি কান্নার আওয়াজ আর অদ্ভুত মন্ত্রচ্চারণ ভেসে আসে। লোকটা আরও বলেছে, অমাবস্যার রাতে মনোহর এক বিশেষ ‘খেল’ দেখাবে, যার জন্য সে সবচেয়ে শক্তিশালী ‘ছায়া’ খুঁজছে। সে নাকি তার মেয়ের আত্মাকে ফিরিয়ে আনবে।”
ভবতোষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সবই মিলে যাচ্ছে। সে তার মেয়ের দেহের উপরই ‘পঞ্চকায়া’ আচার প্রয়োগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সে জানে না, যে আত্মা ফিরে আসবে, তা আর তার মিষ্টি মেয়ে মায়ার থাকবে না। তা হবে এক ক্ষুধার্ত প্রেত, যার একমাত্র চাহিদা হবে আরও প্রাণশক্তি।”
তিনি শরৎকে বললেন, “শরৎ, এখন আমাদের খুব সাবধানে চলতে হবে। অমাবস্যার রাতে আসল খেলাটা হবে। তার আগে আমাকে আমার প্রস্তুতি সারতে হবে। তুমি শুধু একটা কাজ করো। ওই অনাদিবাবু এবং অন্য যারা রোজ ওই নাচ দেখতে যায়, তাদের উপর নজর রাখো। তারা যেন অমাবস্যার রাতে কোনোভাবেই ওই নাটমন্দিরে যেতে না পারে। প্রয়োজনে তাদের বাড়ির লোককে বুঝিয়ে বলো, আটকে রাখো।”
শরৎ সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। ভবতোষ আবার তাঁর কাজে মন দিলেন। তাঁর ছায়া-দর্পণ তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। এখন শুধু বাকি অমাবস্যার রাতের চূড়ান্ত শোধন। তিনি জানতেন, সেই রাতে তাঁকে শুধু এক শোকার্ত পিতার ভ্রান্ত সাধনার বিরুদ্ধেই লড়তে হবে না, লড়তে হবে এক ভয়ঙ্কর অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, যা মুক্তি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। অমাবস্যার রাত যত এগিয়ে আসছিল, ভবতোষের ঘরের বাতাসেও যেন একটা চাপা উত্তেজনা আর শীতলতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion