অপূর্ব রাধিকার অতীত জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। তার মনে হচ্ছিল, এই রহস্যের জট না খুললে তারা দু’জনেই বিপদে পড়বে, হয়তো তাদের জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়বে। সে রাধিকাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, তার গলায় এক তীব্র উদ্বেগ, তার চোখ দুটো রাধিকার দিকে স্থির। “রাধিকা, তোমার কি কোনো সমস্যা আছে? তুমি কি কিছু লুকাচ্ছো? আমার মনে হচ্ছে, কেউ আমাদের পিছু নিচ্ছে, আর এর সাথে তোমার অতীতের কোনো সম্পর্ক আছে। আমি তোমার জন্য খুব চিন্তিত। আমি তোমার গিটার কেসের প্রতীকটা দেখেছি, আর আমার দরজার নিচেও সেই একই প্রতীক পেয়েছি। এমনকি আমার ল্যাপটপে ‘লুমিনা_প্রজেক্ট.এনসিআর’ নামের একটা এনক্রিপ্টেড ফাইলও পেয়েছি।”
রাধিকা চমকে উঠল। তার চোখে এক পলকের জন্য ভয় আর বিষাদের ছায়া নেমে এল, যা অপূর্ব আগে কখনও দেখেনি, যেন এক গভীর ক্ষত তার আত্মায় লুকিয়ে আছে। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। “না, অপূর্ব। কেন এমন বলছো? আমার কোনো সমস্যা নেই।” তার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল, তার হাত দুটো কাঁপছিল, যেন সে কোনো গোপন কথা বলতে চাইছে না, কিন্তু তার চোখ দুটো যেন কিছু বলতে চাইছিল।
“রাধিকা, আমাকে বিশ্বাস করো। আমি তোমার পাশে আছি। তুমি আমাকে সব বলতে পারো। আমরা একসাথে এর মোকাবিলা করব।” অপূর্ব তার হাত ধরে বলল, তার চোখে ছিল এক গভীর বিশ্বাস, যা রাধিকার মনে এক নতুন আশা জাগিয়ে তুলল।
রাধিকা অপূর্বর চোখে তাকিয়ে দেখল, সেখানে কোনো সন্দেহ নেই, শুধু ভালোবাসা আর উদ্বেগ। সে অপূর্বর হাত ধরে বলল, তার গলায় এক তীব্র আকুতি। “অপূর্ব, আমি তোমাকে সব বলব। কিন্তু এখন নয়। সঠিক সময় এলে আমি তোমাকে সব খুলে বলব। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমার অতীত খুব অন্ধকার, এক ভয়ঙ্কর ছায়া আমাকে তাড়া করছে, আমি তোমাকে তাতে জড়াতে চাই না। ওরা খুব শক্তিশালী, ওরা কাউকে ছাড়ে না। ওরা সব জানে।”
অপূর্ব রাধিকাকে বিশ্বাস করল। কিন্তু তার মন শান্ত হল না। রাধিকার ভয় তাকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলল, তার মনে এক তীব্র ছটফটানি শুরু হল। সে সিদ্ধান্ত নিল, নিজেই রাধিকার অতীত খুঁজে বের করবে। সে রাধিকার পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে শুরু করল, তার ল্যাপটপে রাধিকার কিছু পুরনো ছবি ছিল। একটি ছবিতে সে দেখল, রাধিকা একটি পুরনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটি দেখতে খুব অদ্ভুত, যেন অনেক দিন ধরে পরিত্যক্ত, তার দেওয়ালে সেই একই অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা, যা এখন অপূর্বর কাছে এক অশুভ চিহ্ন। ছবির নিচে একটি ছোট ক্যাপশন ছিল – “শান্তিনিকেতন, ২০০৮।”
অপূর্বর মনে হল, এটাই সূত্র, এটাই রহস্যের চাবিকাঠি। সে শান্তিনিকেতন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রাধিকাকে সে বলল, তার অফিসের কাজে তাকে দু’দিনের জন্য বাইরে যেতে হবে। রাধিকা কিছু সন্দেহ করল না, যদিও তার চোখে এক অজানা উদ্বেগ ছিল, যেন সে বুঝতে পারছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে, যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
অপূর্ব শান্তিনিকেতন পৌঁছাল। ছবির বাড়িটি খুঁজে বের করতে তার বেশি সময় লাগল না। বাড়িটি সত্যিই পরিত্যক্ত ছিল, চারদিকে আগাছা আর ভাঙা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিল। বাড়ির বাতাসে এক অদ্ভুত থমথমে ভাব, যেন প্রতিটি কোণে এক অজানা ইতিহাস লুকিয়ে আছে, প্রতিটি ধুলোর কণা এক গোপন কথা বলতে চাইছে। অপূর্ব সাবধানে বাড়ির ভেতরে ঢুকল, তার প্রতিটি পদক্ষেপে এক অজানা আশঙ্কা, তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছিল। ভেতরে সবকিছু ধুলোয় ঢাকা, যেন বহু বছর ধরে কেউ এখানে আসেনি। প্রতিটি পদক্ষেপে ভাঙা কাঁচের মর্মর শব্দ হচ্ছিল, যা নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। সে দেখল, একটি পুরনো ডায়েরি মেঝেতে পড়ে আছে, তার ওপরে ধুলোর পুরু আস্তরণ। ডায়েরিটি রাধিকার হাতের লেখা, তার প্রতিটি অক্ষর যেন এক গোপন কথা বলার জন্য ছটফট করছিল। অপূর্ব পাতা উল্টাতে শুরু করল, তার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছিল, যেন সে এক নিষিদ্ধ সত্যের মুখোমুখি হচ্ছে।
ডায়েরিতে রাধিকার জীবনের এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়ের কথা লেখা ছিল। রাধিকার আসল নাম ছিল রাধিকা নয়, রঞ্জনা। তার বাবা একজন বিজ্ঞানী ছিলেন, যিনি একটি গোপন গবেষণা করছিলেন, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিতে পারত। কিন্তু কিছু আন্তর্জাতিক গুপ্তচর সংস্থা, যাদের প্রতীক ছিল সেই অদ্ভুত চিহ্ন, সেই গবেষণার পেছনে লেগেছিল। তারা রঞ্জনার বাবাকে অপহরণ করে তার গবেষণা চুরি করতে চেয়েছিল, যা বিশ্বজুড়ে এক নতুন যুদ্ধ শুরু করতে পারত।
ডায়েরিতে লেখা ছিল, একদিন রাতে কিছু মুখোশধারী লোক তাদের বাড়িতে হামলা চালায়। রঞ্জনার বাবা-মা তাদের রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেননি। রঞ্জনার বাবা-মাকে নির্মমভাবে খুন করা হয়, তাদের আর্তনাদ যেন এখনও ডায়েরির পাতায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। রঞ্জনা কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে আসে, তার হাতে ছিল তার বাবার দেওয়া একটি গোপন কোড এবং একটি ছোট পেনড্রাইভ। তার বাবা মৃত্যুর আগে তাকে ফিসফিস করে বলেছিলেন, “রঞ্জনা, এটা খুব সাবধানে রাখবি। এটা শুধু দেশের ভবিষ্যৎ নয়, এটা মানবজাতির ভবিষ্যৎ। এটা ওদের হাতে পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে।” ডায়েরির শেষ পাতায় একটি অস্পষ্ট হাতে লেখা ছিল, “ওরা আসবে… ওরা সব জানে… লুমিনা…। ওরা ছায়ার মতো…।”
রঞ্জনা পালিয়ে আসার পর থেকে লুকিয়ে জীবনযাপন করছিল। সে তার পরিচয় বদলে রাধিকা নাম নিয়েছিল, যেন সে তার অতীতকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। সে জানত, সেই গুপ্তচর সংস্থাগুলো এখনও তাকে খুঁজছে, কারণ তারা জানে না পেনড্রাইভটি কার কাছে আছে। সে একা ছিল, অসহায় ছিল। তার জীবনে অপূর্ব এসেছিল এক ঝলক আলোর মতো। কিন্তু সে জানত, তার অতীত অপূর্বর জীবনকেও বিপদে ফেলতে পারে, তাকেও এই অন্ধকার জগতে টেনে আনতে পারে।
অপূর্ব ডায়েরিটি শেষ করল। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, তার শরীর কাঁপছিল। রাধিকার নীরবতার কারণ সে বুঝতে পারল। তার সরল, মিষ্টি রাধিকা এত ভয়ঙ্কর এক অতীতের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে! অপূর্ব নিজেকে অপরাধী মনে করল। সে রাধিকাকে বিশ্বাস করেনি, তার পিছু নিয়েছে। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারল, রাধিকা শুধু তার ভালোবাসার মানুষ নয়, তার সুরক্ষারও দায়িত্ব তার ওপর। এই রহস্যের গভীরে সে নিজেও জড়িয়ে পড়েছে, এবং এর থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই। তার মনে হল, সে যেন এক ভয়ঙ্কর খেলায় ঢুকে পড়েছে, যার নিয়ম সে জানে না, এবং যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion