Episode 31254 words0 views

তৃতীয় অধ্যায়: গোপন অভিসন্ধি

অরিন্দম পরের কয়েকদিন দেবব্রত রায়ের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আরও গভীরে অনুসন্ধান শুরু করলেন। তিনি কলকাতার কিছু পরিচিত সূত্রকে ফোন করে দেবব্রত রায়ের সাম্প্রতিক ব্যবসায়িক লেনদেন এবং তাঁর শত্রুদের সম্পর্কে খোঁজ নিলেন। যে তথ্যগুলো উঠে এল, তা বেশ চাঞ্চল্যকর। জানা গেল, দেবব্রত রায় সম্প্রতি কাশ্মীরে একটি বড় পর্যটন প্রকল্প শুরু করার পরিকল্পনা করছিলেন। একটি বিলাসবহুল রিসর্ট এবং কিছু নতুন হাউসবোট তৈরির জন্য তিনি বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। এই প্রকল্পের জন্য তিনি স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। কিন্তু এই প্রকল্প নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। কিছু মানুষ এটিকে উন্নয়নের সুযোগ হিসেবে দেখলেও, অনেকেই পরিবেশ এবং স্থানীয় সংস্কৃতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। অরিন্দমের মনে হলো, এই ব্যবসায়িক চুক্তিই হয়তো দেবব্রত রায়ের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। হয়তো এই চুক্তির সঙ্গে জড়িত কোনো পক্ষ তাঁকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল, অথবা এমন কোনো গোপন তথ্য তাঁর কাছে ছিল, যা ফাঁস হয়ে গেলে অনেকের ক্ষতি হতে পারত। তিনি ইনস্পেক্টর রফিক আহমেদের সঙ্গে আবার দেখা করলেন। রফিক সাহেব ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে নিয়ে বসেছিলেন। “মিস্টার সেন, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেবব্রত রায়কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। আঘাতটি এত গভীর ছিল যে, তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।” “সবুজ সুতোর টুকরোর কী হলো?” অরিন্দম জানতে চাইলেন। “সেটা পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এটা সাধারণ কাশ্মীরি শালের সুতো।” রফিক সাহেব বললেন। “কিন্তু ইনস্পেক্টর, দেবব্রত রায়ের দেহরক্ষীদের অনুপস্থিতি, আর হাউসবোটে একজন অপরিচিত ব্যক্তির আগমন – এগুলো কি আপনাদের ভাবাচ্ছে না?” অরিন্দম প্রশ্ন করলেন। রফিক সাহেব গম্ভীর হলেন। “হ্যাঁ, আমরা এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। আমরা সেই অপরিচিত ব্যক্তির স্কেচ তৈরি করার চেষ্টা করছি, ইসমাইলের বর্ণনা অনুযায়ী। আর দেহরক্ষীদেরও আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।” অরিন্দম দেবব্রত রায়ের পর্যটন প্রকল্পের কথা রফিক সাহেবকে জানালেন। “ইনস্পেক্টর, দেবব্রত রায় কাশ্মীরে একটি বড় পর্যটন প্রকল্প শুরু করতে চেয়েছিলেন। এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কেউ কি তাঁর খুনের পেছনে থাকতে পারে?” রফিক সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন। “এটা একটা নতুন দিক। আমরা এই বিষয়টাও তদন্ত করে দেখব। আপনার কাছে কি সেই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তির নাম আছে?” “না, আমার কাছে নির্দিষ্ট কোনো নাম নেই। তবে আমি শুনেছি, তিনি স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করছিলেন।” অরিন্দম রফিক সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার নিজের তদন্তে নামলেন। তিনি শ্রীনগরের সেইসব এলাকায় গেলেন, যেখানে পর্যটন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা চলছিল। তিনি স্থানীয় হোটেলের মালিক, পর্যটন ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি জানতে পারলেন, দেবব্রত রায়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে একটি বড় বিভেদ ছিল। একদল মানুষ, যারা অর্থনৈতিক উন্নতির স্বপ্ন দেখত, তারা এই প্রকল্পের পক্ষে ছিল। কিন্তু অন্য একটি দল, যার নেতৃত্বে ছিলেন একজন প্রবীণ সমাজকর্মী, আব্দুল হামিদ, তারা এই প্রকল্পের ঘোর বিরোধী ছিলেন। আব্দুল হামিদ মনে করতেন, এই ধরণের বৃহৎ প্রকল্প কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেবে। অরিন্দম আব্দুল হামিদের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আব্দুল হামিদ একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর একটি ছোট লাইব্রেরি ছিল, যেখানে তিনি স্থানীয় ইতিহাস এবং সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করতেন। অরিন্দম আব্দুল হামিদের কাছে গিয়ে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিলেন এবং দেবব্রত রায়ের খুনের বিষয়ে জানতে চাইলেন। আব্দুল হামিদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “দেবব্রত রায় একজন লোভী মানুষ ছিলেন, মিস্টার সেন। তিনি কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রকল্প আমাদের উপত্যকার জন্য অভিশাপ ছিল।” “আপনি কি মনে করেন, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে এই প্রকল্পের কোনো যোগসূত্র আছে?” অরিন্দম সরাসরি প্রশ্ন করলেন। আব্দুল হামিদ কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তাঁর চোখ দূরের বরফাবৃত পাহাড়ের দিকে নিবদ্ধ। “আমি জানি না, মিস্টার সেন। তবে আমি নিশ্চিত, তাঁর মৃত্যুর পেছনে শুধু ডাকাতি নয়, আরও গভীর কোনো কারণ আছে। এই উপত্যকায় অনেক গোপন শত্রু লুকিয়ে আছে। এমন শত্রু, যাদের ছায়া এত দীর্ঘ যে, তাদের নাম উচ্চারণ করাও বিপজ্জনক।” তাঁর কণ্ঠস্বরে এক ধরণের চাপা ভয়। অরিন্দম সবুজ সুতোর টুকরোটির কথা ভাবলেন। “আব্দুল সাহেব, আপনি কি এই ধরণের কোনো শালের সুতো চিনতে পারেন?” অরিন্দম সুতোর টুকরোটি আব্দুল হামিদকে দেখালেন। আব্দুল হামিদ সুতোর টুকরোটি হাতে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। তাঁর চোখে এক ধরণের বিস্ময় ফুটে উঠল। “এটা… এটা তো খুব পুরনো ধরণের সুতো। আজকাল এই ধরণের সুতো দিয়ে শাল তৈরি হয় না। এটা সম্ভবত ‘পশমিনা’ শালের সুতো, যা অনেক বছর আগে তৈরি হয়েছিল। এই ধরণের শাল খুব বিরল এবং দামি। শুধুমাত্র কাশ্মীরের কিছু পুরনো পরিবারেই এই ধরণের শাল দেখা যায়।” অরিন্দমের মনে এক নতুন আশার আলো জ্বলে উঠল। বিরল এবং দামি! তার মানে এটা সাধারণ সুতো নয়। “আপনি কি জানেন, কে এই ধরণের শাল ব্যবহার করে?” আব্দুল হামিদ কিছুক্ষণ ভাবলেন। তাঁর মুখে এক ধরণের দ্বিধা। “আমি নিশ্চিত নই, মিস্টার সেন। তবে শ্রীনগরের পুরনো বাজারের ‘কাশ্মীরি হস্তশিল্প’ দোকানে এই ধরণের শাল পাওয়া যেতে পারে। তাদের কাছে পুরনো শালের একটি বিশাল সংগ্রহ আছে। তবে সেখানেও সব তথ্য পাওয়া কঠিন।” অরিন্দম আব্দুল হামিদকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত সেই দোকানের দিকে রওনা দিলেন। শ্রীনগরের পুরনো বাজার একটি গোলকধাঁধার মতো। সরু গলি, ছোট ছোট দোকান, আর মানুষের ভিড়। ‘কাশ্মীরি হস্তশিল্প’ দোকানটি খুঁজে বের করতে তাঁর বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। দোকানের মালিক একজন বয়স্ক শিখ ভদ্রলোক, নাম সর্দারজি। তিনি অরিন্দমকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। অরিন্দম তাঁকে সবুজ সুতোর টুকরোটি দেখালেন এবং এই ধরণের শালের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সর্দারজি সুতোর টুকরোটি দেখে মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ, এটা পুরনো পশমিনা শালের সুতো। এই ধরণের শাল খুব কম পাওয়া যায়। এগুলো হাতে তৈরি, এবং এর বুনন খুব সূক্ষ্ম। আমার দোকানে এই ধরণের কিছু পুরনো শাল আছে।” সর্দারজি অরিন্দমকে একটি পুরনো আলমারি দেখালেন। আলমারির ভেতরে সারি সারি পুরনো কাশ্মীরি শাল রাখা ছিল। অরিন্দম প্রতিটি শাল খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ আটকে গেল একটি শালের ওপর। শালটি ছিল গাঢ় সবুজ রঙের, তার বুনন ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। আর সেই শালের এক কোণে, অরিন্দম একটি ছোট, প্রায় অদৃশ্য, ছেঁড়া সুতোর জায়গা দেখতে পেলেন। সেই ছেঁড়া জায়গাটি সবুজ সুতোর টুকরোটির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছিল। অরিন্দমের হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হতে শুরু করল। তিনি নিশ্চিত হলেন, এটাই সেই শাল। “এই শালটি কার, সর্দারজি? কে এটা কিনেছিল?” সর্দারজি কিছুক্ষণ ভাবলেন। তাঁর মুখে এক ধরণের অস্বস্তি। “এই শালটি অনেক বছর আগে একজন খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি কিনেছিলেন। তাঁর নাম ছিল মীর সাহেব। তিনি একজন ধনী জমিদার ছিলেন। তবে তিনি এখন আর বেঁচে নেই। তাঁর ছেলে, মীর জাফার, এখন এই শালের মালিক।” সর্দারজি কথাগুলো বলতে গিয়ে যেন একটু ইতস্তত করলেন। তাঁর চোখে এক ধরণের চাপা ভয়। মীর জাফার! অরিন্দম এই নামটা শুনেছিলেন। তিনি শ্রীনগরের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত ব্যবসায়ী। তাঁর নামও বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনামে এসেছে। তিনি দেবব্রত রায়ের প্রস্তাবিত পর্যটন প্রকল্পের একজন প্রধান অংশীদার ছিলেন। অরিন্দমের মনে সব কিছু স্পষ্ট হতে শুরু করল। মীর জাফারই সেই অপরিচিত ব্যক্তি, যে খুনের রাতে দেবব্রত রায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আর এই শালটিই খুনের একমাত্র প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কিন্তু কেন মীর জাফার দেবব্রত রায়কে খুন করবে? যদি তারা অংশীদারই হয়, তাহলে তাদের মধ্যে কী এমন বিরোধ হয়েছিল যে, তা খুনে পর্যবসিত হলো? এই প্রশ্ন অরিন্দমের মনে এক নতুন রহস্যের জন্ম দিল। তিনি বুঝতে পারলেন, এই খেলাটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ততটা সহজ নয়। অরিন্দম সর্দারজিকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত ইনস্পেক্টর রফিক আহমেদের অফিসের দিকে রওনা দিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর হাতে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র আছে, যা এই রহস্যের সমাধান করতে সাহায্য করবে। কিন্তু তাঁর মনে এক অজানা আশঙ্কা বাসা বাঁধল। মীর জাফরের মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করা কতটা নিরাপদ হবে? ইনস্পেক্টর রফিক আহমেদ অরিন্দমের কথা মন দিয়ে শুনলেন। তিনি সবুজ শালটি এবং মীর জাফরের নাম শুনে চমকে উঠলেন। “মীর জাফার! তিনি তো আমাদের শহরের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তাঁর প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।” রফিক সাহেবের কণ্ঠে এক ধরণের উদ্বেগ। “কিন্তু ইনস্পেক্টর, এই শালটিই একমাত্র প্রমাণ। আর ইসমাইলের বর্ণনা অনুযায়ী, সেই অপরিচিত ব্যক্তিটি মীর জাফরের চেহারার সঙ্গে মিলে যায়।” অরিন্দম দৃঢ় কণ্ঠে বললেন। রফিক সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন। তাঁর কপালে চিন্তার রেখা। “ঠিক আছে, মিস্টার সেন। আমরা মীর জাফরের সঙ্গে কথা বলব। তবে তাঁর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছাড়া পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন। আর যদি তিনি সত্যিই জড়িত থাকেন, তাহলে এই তদন্ত আমাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।” অরিন্দম জানতেন, মীর জাফরের মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সহজ হবে না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি জানতেন, এই রহস্যের গভীরে আরও অনেক কিছু লুকিয়ে আছে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion