Episode 3916 words0 views

গঙ্গার ধারে শেষ রাত : তৃতীয় অধ্যায়

গোপন পথ পরের দুটো দিন অনিন্দিতা প্রায় ঘোরের মধ্যে কাটাল। একদিকে দাদুর শ্রাদ্ধশান্তির কাজ, অন্যদিকে তার মাথায় ঘুরপাক খাওয়া হাজারো প্রশ্ন। রাধাকান্ত সেনের ডায়েরিটা সে তার ল্যাপটপ ব্যাগের এক গোপন পকেটে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল। সবার সামনে সে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে যাচ্ছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার সাংবাদিক সত্তাটা জেগে উঠেছিল, ক্ষুধার্ত বাঘের মতো। তার কাকা প্রশান্ত সেনের লোভী চাহনি আর বারবার প্রোমোটারের কথা তোলাটা তার মনে সন্দেহের একটা নতুন কাঁটা ফুটিয়েছিল। ‘Sous la lune’—‘চাঁদের নিচে’। এই দুটো শব্দ তাকে রাতে ঘুমোতে দিচ্ছিল না। এর মানে কী হতে পারে? বাড়ির নিচে সেই গোপন কুঠুরি, যার কথা ডায়েরিতে লেখা আছে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? বাড়িটা একটা গোলকধাঁধার মতো। গঙ্গার দিকে অনেকগুলো ঘর, তার নিচে तळঘরও আছে। কিন্তু কোনটা সেই বিশেষ কুঠুরি? তৃতীয় দিন বিকেলে, সব লৌকিকতা চুকে যাওয়ার পর, বাড়িটা যখন আবার আগের মতো শান্ত, তখন সে কাজে নামল। হাতে ডায়েরির নকশাটা আর একটা শক্তিশালী টর্চ নিয়ে সে প্রথমে तळঘরে গেল। স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার একটা জায়গা। মাকড়সার জাল আর পুরোনো ভাঙা আসবাবে ভর্তি। বাতাসে শুধু ধুলো আর পুরনো কাঠের গন্ধ নয়, একটা ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধও ছিল, যা গঙ্গার নৈকট্যকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। দেওয়ালে চুন-সুরকির পলেস্তারা খসে পড়ছে, 드러난 ইঁটগুলো যেন বাড়ির কঙ্কাল। অনিন্দিতা টর্চের আলো ফেলে নকশার সাথে মেলানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই মিলল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সে প্রতিটি দেওয়াল, প্রতিটি কোণ পরীক্ষা করল, কিন্তু কোনো গোপন পথের চিহ্নমাত্র পেল না। হতাশ হয়ে সে আবার লাইব্রেরি ঘরে ফিরে এল। হয়তো ‘চাঁদের নিচে’ কথাটার আক্ষরিক কোনো অর্থ নেই, এটা একটা রূপক। কিন্তু কীসের রূপক? তার দাদু, একজন শব্দশিল্পী, তিনি নিশ্চয়ই এমন কোনো সংকেত রেখে গেছেন যার অর্থ এতটাও সহজ নয়। সে অরিন্দম সেনের বইয়ের তাকগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটতে লাগল। তার দাদু ছিলেন বইয়ের পোকা। ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য—কিছুই বাদ ছিল না। হঠাৎ একটা বইয়ের দিকে তার চোখ গেল। বইটার নাম ‘Symbolism in French Architecture’। বইটা শেলফ থেকে বের করতেই তার ভেতর থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ পড়ল। কাগজটা খুলতেই অনিন্দিতা দেখল, সেটা এই বাড়িরই একটা পুরনো ব্লুপ্রিন্ট। সম্ভবত রাধাকান্ত সেনের আমলের। আর সেই ব্লুপ্রিন্টের এক কোণায়, পেন্সিল দিয়ে একটা গোল চিহ্ন আঁকা আর পাশে লেখা— ‘La lune’. চাঁদ। অনিন্দিতা উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠছিল। সে ব্লুপ্রিন্টটা ভালো করে দেখতে লাগল। গোল চিহ্নটা দেওয়া আছে বাড়ির পেছনের দিকে, যেখানে একটা পুরনো ফোয়ারা ছিল। ফোয়ারাটা এখন শুকিয়ে গেছে, তার চারপাশে আগাছার জঙ্গল। কিন্তু ছোটবেলায় সে ওই ফোয়ারার পাশে খেলা করত। তার আবছা মনে আছে, ফোয়ারার মাঝখানে একটা ভাঙা পরীমূর্তি ছিল, যার হাতে ছিল একটা অর্ধচন্দ্র। চাঁদ! ‘La lune’! তার আর এক মুহূর্তও দেরি করতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু বাইরে তখন সন্ধ্যা নামছে। একা একা ওই জঙ্গলের মতো জায়গায় যাওয়াটা ঠিক হবে না। সে ভোলাদাকে ডাকল। “ভোলাদা, বাড়ির পেছনের ওই ফোয়ারাটার কথা তোমার মনে আছে?” ভোলাদা অবাক হয়ে বলল, “কোন ফোয়ারা গো দিদিমণি? ও তো জঙ্গল হয়ে গেছে। সাপখোপ থাকতে পারে। ওদিকে যেও না।” “না, আমাকে একবার যেতেই হবে। তুমি সাথে চলো। হাতে একটা লাঠি নিও।” ভোলাদা প্রথমে রাজি না হলেও, অনিন্দিতার জেদের কাছে হার মানল। একটা টর্চ, একটা লাঠি আর নকশাটা নিয়ে ওরা দু’জন বাড়ির পেছনের দিকে গেল। আগাছা আর ঝোপঝাড় সরিয়ে ফোয়ারাটার কাছে পৌঁছতে বেশ বেগ পেতে হলো। ফোয়ারাটা এখন শ্যাওলায় ঢাকা একটা ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু তার মাঝখানে ভাঙা পরীমূর্তিটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আর তার হাতে সেই অর্ধচন্দ্র। অনিন্দিতা টর্চের আলো ফেলল চাঁদের ওপর। চাঁদের গায়ে ফরাসি ভাষায় কী যেন খোদাই করা। শ্যাওলা পরিষ্কার করতেই লেখাটা স্পষ্ট হলো— ‘Regarde en bas’— অর্থাৎ, ‘নিচে তাকাও’। অনিন্দিতা পরীমূর্তির ঠিক নিচে, ফোয়ারার শুকনো চৌবাচ্চার দিকে তাকাল। সেখানে একটা চৌকো পাথরের স্ল্যাব, অন্যগুলোর চেয়ে একটু আলাদা। সে আর ভোলাদা মিলে গায়ের জোরে স্ল্যাবটা সরাতেই একটা ঠান্ডা, সোঁদা হাওয়া উঠে এল। নিচে নামার জন্য কয়েকটা পাথরের ধাপ দেখা যাচ্ছে। অনিন্দিতার বুকটা ধড়াস ধড়াস করছিল। সে পেয়ে গেছে। রাধাকান্ত সেনের সেই গোপন কুঠুরির প্রবেশপথ। “তুমি এখানে দাঁড়াও ভোলাদা। আমি আসছি,” বলে সে টর্চ হাতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। সিঁড়িটা শেষ হয়েছে ছোট্ট একটা ঘরে। ঘরটার দেওয়াল পাথরের। একটা দিকে একটা লোহার দরজা, তাতে বিশাল একটা তালা ঝুলছে। দরজার পাশেই দেওয়ালে একটা বড় ফোকর, যেটা দিয়ে গঙ্গার জল দেখা যায়। সম্ভবত মালপত্র ওঠানো-নামানোর জন্য এটা ব্যবহার করা হতো। অনিন্দিতা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তালাটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বহু বছর এটা খোলা হয়নি। এর চাবি কোথায়? হঠাৎ তার মনে হলো, কেউ তাকে দেখছে। সে চমকে পেছনে তাকাল। সিঁড়ির মুখে কেউ নেই। কিন্তু তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, সে একা নয়। একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল। “কিছু পেলে দিদিমণি?” ভোলাদা উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল। “একটা লোহার দরজা আছে, কিন্তু তালা দেওয়া। চাবিটা খুঁজতে হবে।” ওরা যখন বাড়ির ভেতরে ফিরে আসছে, তখন অনিন্দিতার চোখ গেল দোতলার বারান্দার দিকে। তার মনে হলো, একটা ছায়ামূর্তি যেন খুব দ্রুত সেখান থেকে সরে গেল। সে থমকে দাঁড়াল। “কে ওখানে?” সে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু কোনো উত্তর এল না। ভোলাদা বলল, “কোথায় কে? তোমার চোখের ভুল হবে।” কিন্তু অনিন্দিতা জানে, ওটা চোখের ভুল নয়। কেউ তাদের ওপর নজর রাখছে। তার কাকা প্রশান্ত সেনের লোভী মুখটা তার মনে ভেসে উঠল। নাকি সে ‘লিলির রক্ষক’-এর কোনো সদস্য? যার চোখ পান্নার মতো সবুজ? সেদিন রাতে অনিন্দিতা নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসেছিল। ভয় আর উত্তেজনা মিলেমিশে একাকার। সে বুঝতে পারছিল, এই গুপ্তধনের রহস্য শুধু আর ডায়েরির পাতায় সীমাবদ্ধ নেই। এটা এখন বাস্তব। আর এই খেলায় সে একা নয়, তার প্রতিপক্ষও আছে। অদৃশ্য, কিন্তু ভয়ঙ্কর। সে ঠিক করল, পরদিন সকালে অধ্যাপক পার্থসারথি ঘোষের সাথে দেখা করবে। এই ‘লিলির রক্ষক’ আর তাদের প্রতীক নিয়ে আরও তথ্য তার জানা দরকার। আর ওই লোহার দরজার চাবিটাও খুঁজে বের করতে হবে। চাবিটা হয়তো এই বাড়িরই কোথাও লুকিয়ে রাখা আছে। হয়তো তার দাদুর কোনো বইয়ের ভেতরে, কিংবা তার লেখার টেবিলের কোনো গোপন ড্রয়ারে। অনিন্দিতা জানত, লড়াইটা কঠিন হতে চলেছে। কিন্তু সে পিছু হটবে না। তার দাদুর মৃত্যুর সুবিচার তাকে করতেই হবে।

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion