Episode 4880 words0 views

গঙ্গার ধারে শেষ রাত : চতুর্থ অধ্যায়

চাবি ও সিন্দুক পরদিন সকালের আলো ফোটার সাথে সাথেই অনিন্দিতার ঘুম ভেঙে গেল। রাতের অস্বস্তিটা তখনও কাটেনি। দোতলার বারান্দায় দেখা সেই ছায়ামূর্তিটা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছে না। সে ঠিক করল, আর দেরি করা নয়। অধ্যাপক পার্থসারথি ঘোষের সাথে দেখা করাটা এখন সবচেয়ে জরুরি। চন্দননগর গভর্নমেন্ট কলেজের গেটের সামনে গাড়িটা দাঁড় করাতেই অনিন্দিতা দেখল, পার্থসারথি বাবু কয়েকজন ছাত্রের সাথে কথা বলছেন। অনিন্দিতাকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। “আরে, আপনি! আসুন, আসুন। সব ঠিক আছে তো?” “একটা জরুরি কথা ছিল, স্যার। আপনার একটু সময় হবে?” পার্থসারথি বাবু অনিন্দিতার মুখের উদ্বেগ লক্ষ করলেন। “চলুন, আমার ঘরে গিয়ে বসি।” কলেজের স্টাফ রুমে বসে অনিন্দিতা তাকে সবটা খুলে বলল। রাধাকান্ত সেনের ডায়েরি, গুপ্তধনের কথা, ‘লিলির রক্ষক’ সমিতি, ফোয়ারার নিচের গোপন কুঠুরি আর তালা দেওয়া লোহার দরজা—সবকিছু। সে শুধু ছায়ামূর্তির কথাটা এড়িয়ে গেল, কারণ তার কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না। সব শুনে পার্থসারথি বাবুর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “আমি যা সন্দেহ করেছিলাম, তাই। অরিন্দমবাবু নিশ্চয়ই এই রহস্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। আর সেই কারণেই হয়তো…”—তিনি কথাটা শেষ করলেন না। “স্যার, এই ‘লিলির রক্ষক’ কারা? এদের সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়?” পার্থসারথি বাবু বললেন, “আমার গবেষণা অনুযায়ী, এরা ছিল ফরাসি রাজতন্ত্রের প্রতি অনুগত একটি গুপ্ত গোষ্ঠী। তাদের কাজ ছিল ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা রাজপরিবারের সমর্থকদের পাঠানো সম্পদ রক্ষা করা। চন্দননগরে তাদের মূল ঘাঁটি ছিল। জ্যাঁ-পিয়ের ছিলেন তাদের নেতা। কিন্তু তার মৃত্যুর পর, সমিতির দায়িত্ব নেয় একটি স্থানীয় ফরাসি পরিবার—দ্যুবইস পরিবার। এই পরিবারের সদস্যদের একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল—তাদের চোখের মণি ছিল পান্না সবুজ।” অনিন্দিতার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। “এই পরিবার কি এখনও এখানে আছে?” “সরাসরি নেই। দেশভাগের পর তারা ফ্রান্স বা পণ্ডিচেরিতে চলে যায়। কিন্তু শোনা যায়, তাদের বংশের কেউ কেউ নাম বদলে এখানেই থেকে গিয়েছিল। আর সমিতির দায়িত্বও তাদের হাতেই ছিল। তারা এখনও হয়তো সেই গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে। অথবা, পাওয়ার চেষ্টা করছে।” “কিন্তু দেড়শো বছরের পুরনো একটা তালার চাবি আমি কোথায় পাব?” অনিন্দিতা হতাশ গলায় বলল। পার্থসারথি বাবু কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, “ফরাসি প্রতীকীবাদে চাবি হলো জ্ঞানের প্রতীক। আর লিলি ফুল হলো পবিত্রতার প্রতীক। রাধাকান্ত সেন যেহেতু একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন এবং ফরাসি সংস্কৃতি দ্বারাও প্রভাবিত ছিলেন, তাই তিনি চাবিটা এমন কোথাও রাখতে পারেন, যেখানে জ্ঞান এবং পবিত্রতা—দুটোই একসাথে পাওয়া যায়।” “মানে?” “আপনার দাদুর লাইব্রেরি। সেখানে বইয়ের চেয়ে পবিত্র আর জ্ঞানের আধার কী হতে পারে? এমন কোনো বই দেখুন, যার সাথে লিলি ফুলের কোনো যোগ আছে। অথবা ফরাসি রাজতন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে কোনো বই। চাবিটা হয়তো তারই ভেতরে লুকিয়ে রাখা আছে।” পার্থসারথি বাবুর কথায় অনিন্দিতা নতুন করে আশা খুঁজে পেল। সে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। লাইব্রেরি ঘরে ফিরে এসে সে আবার বইয়ের তাকগুলোর সামনে দাঁড়াল। হাজার হাজার বই। এর মধ্যে থেকে একটা নির্দিষ্ট বই খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতো। সে ফরাসি সাহিত্যের তাক থেকে শুরু করল। ভিক্টর হুগো, মোপাসাঁ, বালজাক, ফ্লবেয়ার—কারও বইয়ের নামের সাথে লিলির যোগ নেই। হঠাৎ তার চোখ গেল একটা পুরনো, চামড়ায় বাঁধানো বইয়ের দিকে। বইটার শিরদাঁড়ায় সোনালি হরফে লেখা ‘Le Lys dans la vallée’ (The Lily of the Valley) – অনোরে দ্য বালজাক। উপত্যকার লিলি। অনিন্দিতা কাঁপা কাঁপা হাতে বইটা বের করল। বইটা খুলতেই সে পেয়ে গেল জিনিসটা। বইয়ের মাঝখানের পাতাগুলো কেটে একটা চৌকো গর্ত তৈরি করা হয়েছে। আর তার ভেতরে সযত্নে রাখা আছে একটা পুরনো, মরচে ধরা লোহার চাবি। চাবিটার মাথাটা একটা লিলি ফুলের আকারে তৈরি। উত্তেজনায় অনিন্দিতার সারা শরীর কাঁপছিল। সে চাবিটা পেয়ে গেছে! সে ঠিক করল, দিনের আলো থাকতে থাকতেই গোপন কুঠুরিতে যাবে। সে ভোলাদাকে কিছু না জানিয়ে একাই বাড়ির পেছনের ফোয়ারার দিকে এগিয়ে গেল। পাথরের স্ল্যাবটা সরাতেই সেই স্যাঁতসেঁতে গন্ধটা আবার নাকে এল। টর্চ হাতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল অনিন্দিতা। লোহার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে তালাতে চাবিটা ঢোকাল। বহু বছরের পুরনো তালা, প্রথমে একটু আটকালো। কিন্তু অনিন্দিতা জোরে চাপ দিতেই একটা তীব্র ক্যাঁচ শব্দ করে তালাটা খুলে গেল। দরজাটা ঠেলে খুলতেই একটা ভ্যাপসা, ধুলোর গন্ধ বেরিয়ে এল। অনিন্দিতা টর্চের আলো ফেলল ঘরের ভেতরে। ঘরটা খুব বড় নয়। দেওয়াল ঘেঁষে তিনটে কাঠের সিন্দুক রাখা। সিন্দুকগুলোর কাঠে ঘুণ ধরেছে, কিন্তু সেগুলো অক্ষত। অনিন্দিতা প্রথম সিন্দুকটার দিকে এগিয়ে গেল। ঢাকনাটা খুলতেই তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। টর্চের আলোয় চিকচিক করে উঠল রাশি রাশি স্বর্ণমুদ্রা। ফরাসি লুই দ’র (Louis d’or)। দ্বিতীয় সিন্দুকটা খুলতেই সে দেখল হীরা, চুনি, পান্না বসানো গয়না। আর তৃতীয় সিন্দুকটায় ছিল সেই পান্নাখচিত তরবারি, যার কথা ডায়েরিতে লেখা ছিল। তার পাশে একটা ছোট বাক্স। অনিন্দিতা বাক্সটা খুলল। ভেতরে রেশমি কাপড়ে মোড়া একটা কাগজ। কাগজটা খুলতেই সে দেখল, ফরাসি ভাষায় কিছু লেখা। এটা জ্যাঁ-পিয়েরের লেখা একটা চিঠি। “আমার বন্ধু রাধাকান্ত, যদি তুমি এই চিঠি পড়, তার মানে আমি আর বেঁচে নেই। এই সম্পদ ফ্রান্সের। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এটা একটা অভিশাপ। ‘লিলির রক্ষক’রা এর জন্য রক্ত ঝরাতেও পিছপা হবে না। তাদের বংশধররা এই বাড়ির ওপর নজর রাখবে। তাদের সবুজ চোখ থেকে সাবধান। তারা বিষ প্রয়োগে পারদর্শী। বিশ্বাস করো শুধু তাকেই, যার রক্তে এই বাড়ির অধিকার আছে।” চিঠিটা পড়তে পড়তে অনিন্দিতার হাত কাঁপছিল। তার দাদুর মৃত্যু, চায়ের কাপে চিনির দানা, বোদলেয়ারের কবিতার লাইন—সবকিছু মিলে যাচ্ছিল। তার দাদুকে বিষ দিয়েই মারা হয়েছে। আর খুনি ‘লিলির রক্ষক’-এরই কোনো সদস্য। হঠাৎ সিঁড়ির দিকে একটা শব্দ হলো। কেউ যেন খুব সাবধানে পা ফেলে নামছে। অনিন্দিতা চকিতে টর্চ নিভিয়ে দিয়ে একটা সিন্দুকের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। তার হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে আটকে গেছে। একটা ছায়ামূর্তি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। তার হাতেও একটা টর্চ। সেই আলোয় অনিন্দিতা লোকটার মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল না, কিন্তু তার চোখ দুটো দেখতে পেল। অন্ধকারেও সেই চোখ দুটো পান্নার মতো জ্বলজ্বল করছে। সবুজ চোখ। অনিন্দিতা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। সে বুঝতে পারল, সে গুপ্তধনের সাথে সাথে এক ভয়ঙ্কর খুনিরও মুখোমুখি হয়ে গেছে। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion