ড্রাগনের গুহা ও অন্তিম পরীক্ষা
কয়েকদিনের আরও ক্লান্তিকর যাত্রার পর, অবশেষে আয়ান এক বিশাল, কালো পর্বতের সামনে দাঁড়াল। পর্বতটি ছিল অস্বাভাবিক রকমের উঁচু, তার চূড়া মেঘে ঢাকা, যেন আকাশের সাথে মিশে গেছে, আর তার গা বেয়ে নেমে এসেছে সাদা বরফের রেখা, যা সূর্যের আলোয় ঝলমল করছিল। পর্বতের গা ঘেঁষে এক বিশাল গুহার প্রবেশপথ। মনে হচ্ছিল, কোনো দৈত্য তার মুখ হা করে আছে, তার কালো ফোঁকর দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে যেন চিরতরে হারিয়ে যেতে হয়। গুহার মুখে দাঁড়িয়ে আয়ান অনুভব করল এক প্রাচীন, রহস্যময় শক্তি, যা তাকে ভিতরে প্রবেশ করতে বাধ্য করছিল, কিন্তু একইসাথে এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা জাগাচ্ছিল। এইটাই সেই ড্রাগনের গুহা। গুহার মুখ থেকে এক ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে আসছিল, তাতে ছিল প্রাচীন শ্যাওলার গন্ধ আর মাটির গভীরতা, যা তার মনকে আরও শান্ত করে তুলল।
গুহার ভেতরে প্রবেশ করে আয়ান হতবাক হয়ে গেল। গুহাটি ছিল বিশাল, তার উচ্চতা ছিল এত বেশি যে তার শেষ দেখা যাচ্ছিল না, যেন এক বিশাল ক্যাথেড্রাল, যার সিলিং আকাশ ছুঁয়েছে। গুহার দেয়ালগুলো ছিল খসখসে পাথরে তৈরি, কোথাও মসৃণ, কোথাও তীক্ষ্ণ শিলাখণ্ড বেরিয়ে আছে। হাজার হাজার বছর ধরে গুহার ভেতরে বয়ে যাওয়া জলের ধারা পাথরে অদ্ভুত নকশা তৈরি করেছে, যা শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো দেখাচ্ছিল। গুহার ছাদ থেকে ঝুলে ছিল বিশাল আকারের স্ট্যালাকটাইট, আর নিচে থেকে উঠেছে স্ট্যালাগমাইট, যা দেখতে যেন কোনো প্রাচীন মন্দিরের স্তম্ভ। কিছু জায়গায় ছাদ থেকে জলের ফোঁটা টপ টপ করে পড়ছিল, তার শব্দ গুহার নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছিল। বাতাসে ছিল ভেজা পাথরের গন্ধ, সাথে প্রাচীন শ্যাওলা এবং এক অজানা, মিষ্টি খনিজ পদার্থের ঘ্রাণ। গুহার ভেতরে বাতাস ছিল স্থির, তবে ড্রাগনের ঘুমন্ত নিঃশ্বাসের উষ্ণতা ধীরে ধীরে গুহার বাতাসকে প্রভাবিত করছিল।
গুহার দেয়ালগুলোতে জাদুর চিহ্ন আঁকা, যা প্রাচীন ড্রাগন ভাষা। এই চিহ্নগুলো কোন সাধারণ চিত্রলিপি ছিল না, বরং জীবন্ত মনে হচ্ছিল। চিহ্নগুলো মৃদুভাবে জ্বলছিল, যেন কোনো অদেখা শক্তি সেগুলোকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে, আর তাদের আলোয় গুহার ভেতরটা আলোকিত হয়ে উঠেছিল, যা তার চোখে এক নতুন বিস্ময় নিয়ে এল। এই আলো ছিল নরম, নীলাভ আর সবুজাভ আভায় ভরা, যা গুহার পাথুরে পৃষ্ঠে এক জাদুকরি পরিবেশ তৈরি করছিল। আলোর তীব্রতা মাঝে মাঝে বাড়ছিল, আবার কমছিল, যেন গুহা নিজেই শ্বাস নিচ্ছে। তবে, এই আলোর মাঝেই মাঝে মাঝে ভয়ংকর ছায়াগুলি ভেসে উঠছিল, যা প্রাচীন ড্রাগনদের ক্রোধ বা অতীতের ধ্বংসের ছবি তুলে ধরছিল। এই ছায়াগুলি যেন আয়ানের মনে অজানা ভয় তৈরি করছিল, মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো ভয়ংকর দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছে। একসময়, দেয়ালের জাদুকরি চিহ্নগুলো থেকে অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেল, যেন তারা আয়ানকে সতর্ক করছে, কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না সেই শব্দের অর্থ কী।
গুহার মাঝখানে শুয়ে ছিল এক বিশাল ড্রাগন, যার গা পাথর আর শ্যাওলায় ঢাকা, তার ত্বক ছিল যেন সহস্র বছরের প্রাচীন কোনো পর্বত, যার উপর ছোট ছোট সবুজ গাছ গজিয়ে উঠেছে। তার শরীর ছিল এতটাই বিশাল যে গুহার অনেকটাই দখল করে রেখেছিল, তার বিশাল ডানা গুহার সিলিং পর্যন্ত বিস্তৃত, যেন আকাশকে স্পর্শ করে আছে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস যেন হালকা ভূমিকম্পের মতো গুহার পাথরে কম্পন তুলছিল, আর তার নাক থেকে বের হওয়া উষ্ণ বাতাস গুহার ভেতরের হিমেল ঠান্ডা দূর করছিল, যেন সে নিজেই এক জীবন্ত উষ্ণতার উৎস। ড্রাগনের চোখ দুটি বন্ধ ছিল, মনে হচ্ছিল সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তার স্বপ্নগুলি হয়তো প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাস বলছে, বা ভবিষ্যৎ দেখছে। তার বিশাল, শক্তিশালী থাবার পাশে, এক উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে, রাখা ছিল একটি ডিম। ডিমটি ছিল নীলাভ-সবুজ রঙের, তার ওপর তারার মতো ছোট ছোট আলোর বিন্দু ঝলমল করছিল, যা যেন মহাবিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য ধারণ করে আছে, এক স্বর্গীয় আভার মতো দেখাচ্ছিল। ডিম থেকে আসা আলো গুহার অন্ধকারকে আলোকিত করছিল, আর আয়ানের মনে এক পবিত্র অনুভূতি তৈরি করছিল।
কিন্তু ডিমের চারপাশে ছিল এক অদৃশ্য প্রাচীর। আযান হাত বাড়াতেই তার মনে হলো সে এক শীতল, অদৃশ্য দেয়ালের মুখোমুখি হয়েছে। দেয়ালটি শক্ত হলেও তার কোনো আকার ছিল না, কেবল এক অদৃশ্য শক্তি তাকে ডিমের কাছে যেতে বাধা দিচ্ছিল। সে বৃদ্ধ পথিকের কথা মনে করল— ‘বলের পথ নয়, মনের পথ’। সে গুহার ভেতরে চারপাশে তাকাল। ড্রাগনের বিশাল আকার, তার মুখ থেকে আসা উষ্ণ নিশ্বাস, সব দেখে তার মনে ভয় জাগলেও, তার মনের ভেতরে রিয়ার মুখটা ভেসে উঠল, তার অনাহারক্লিষ্ট ছোট শরীরটা। তার মনে পড়ল গ্রামের মানুষের কষ্ট, তাদের শুষ্ক চোখ, তাদের অনাহারক্লিষ্ট দেহ, তাদের হতাশাময় জীবন। সে কোনো অস্ত্র নিয়ে আসেনি। তার কাছে ছিল শুধু তার সংকল্প, তার নিজের উদ্দেশ্য – গ্রামকে বাঁচানো, রিয়াকে বাঁচানো। সে জানত, এটাই তার একমাত্র পথ।
সে দেখল গুহার দেয়ালে কিছু খোদাই করা লেখা। সেগুলো ছিল প্রাচীন ড্রাগন ভাষা, যা আয়ান পড়তে পারতো না। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল যে সেগুলো কোনো মন্ত্র বা ধাঁধা, হয়তো ডিমের প্রাচীর ভাঙার উপায়। সে হতাশ হলো না। হঠাৎ তার মনে পড়ল, যাত্রাপথে সে একটি ছোট, জীর্ণ বুনো গোলাপের চারা দেখেছিল। সেই চারাটি শুকনো মাটিতে একা একা বাঁচার চেষ্টা করছিল, তার পাতাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল। যদিও তার নিজেরই জলের অভাব ছিল, তার জলপাত্রে জল ছিল খুবই সীমিত, সে তার জলপাত্র থেকে সামান্য জল সেই চারাটিতে ঢেলে দিয়েছিল। সে শুধু চেয়েছিল গাছটা বেঁচে থাকুক, প্রকৃতির এই ছোট্ট জীবনটুকু যেন শুকিয়ে না যায়। সে তখনো জানত না, এই ক্ষুদ্র দয়া তার জীবনে এত বড় ভূমিকা পালন করবে। এই ভাবনাটি তাকে এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরিয়ে তুলল। এই ক্ষুদ্র দয়া, এই নিরর্থক মনে হওয়া কাজটির মধ্যেই হয়তো লুকানো আছে সমাধান, সেই অদৃশ্য প্রাচীর ভেদ করার চাবি।
সে দ্রুত তার ঝুলি থেকে বৃদ্ধ পথিকের দেওয়া সেই জলপাত্রটি বের করল। পাত্রটি এখন খালি, তার ভেতরে কেবল শুষ্কতার দীর্ঘশ্বাস। সে সেটি ড্রাগনের ডিমের দিকে বাড়িয়ে দিল। তার মনে কোনো লোভ ছিল না, কোনো ব্যক্তিগত প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল না, শুধু ছিল প্রকৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং জীবনের প্রতি মমতা। সে নিঃশব্দে নিজের একমাত্র জলটুকু উৎসর্গ করার সেই ঘটনাটি মনে করল। তার হৃদয়ে কেবল ছিল তার গ্রামের প্রতি ভালোবাসা আর এই প্রকৃতির প্রতি এক নিবেদন, এক বিশুদ্ধ আত্মত্যাগ।
মুহূর্তের মধ্যে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ডিমের চারপাশের অদৃশ্য প্রাচীরটি মৃদুভাবে কেঁপে উঠল এবং ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, যেন বাতাস থেকে তৈরি একটি পর্দা সরে গেল, কোনো শব্দ ছাড়াই। ডিমটি যেন তাকে কাছে আসার অনুমতি দিল, তার পবিত্র উদ্দেশ্যকে স্বাগত জানাল। ডিম থেকে আসা আলো যেন আয়ানকে ঘিরে ধরল, তাকে এক শান্তিতে ভরিয়ে তুলল, যেন সে কোনো স্বর্গীয় আভার মধ্যে প্রবেশ করেছে।
আয়ান সাবধানে ডিমের কাছে গেল। সে ডিমটিকে হাতে নিতে ইতস্তত করল। বৃদ্ধ পথিক বলেছিল ড্রাগনরা লোভীদের ঘৃণা করে, আর তাদের শক্তি ভারসাম্য রক্ষা করে। এই ডিম শুধু গ্রামের জন্য বৃষ্টি আনবে না, এটি প্রকৃতির ভারসাম্যও রক্ষা করবে। ডিমটি হাতে নিলে হয়তো এর শক্তি নষ্ট হয়ে যাবে, বা তার পবিত্রতা কলুষিত হবে, অথবা ড্রাগন জাগ্রত হয়ে যাবে। তার মনে হলো, ডিমটি হয়তো এখানে, তার নিজের স্থানেই সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে কার্যকর। ড্রাগনের শক্তিকে তার নিজস্ব বাসস্থানেই থাকতে দেওয়া উচিত, তাকে নিজের মতো করে কাজ করতে দেওয়া উচিত, কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়া।
আয়ান নিজের জলপাত্রটা ডিমের পাশে রাখল। সে কোনো দাবি না করে, কেবল তার নিজের প্রার্থনা নিবেদন করল, তার কণ্ঠস্বর ছিল নরম কিন্তু আন্তরিক: “হে মহান ড্রাগন, আপনার শক্তি প্রয়োজন এই পৃথিবীর, প্রয়োজন আমাদের গ্রামের। এই শুষ্ক ভূমিকে বাঁচান, হে মহান আত্মা। আমার কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া নেই, শুধু আমাদের রক্ষা করুন। আমাদের গ্রামের মানুষকে বাঁচান।” তার কণ্ঠস্বর গুহার পাথরে প্রতিধ্বনিত হলো, আর তার প্রতিটি শব্দে ছিল গভীর আবেগ আর আত্মত্যাগ।
সে ড্রাগনের মুখের দিকে তাকাল। মনে হলো ড্রাগনের বিশাল, পাথুরে চোখ দুটি সামান্য নড়ে উঠল, তার গা থেকে শ্যাওলার কিছু অংশ খসে পড়ল, যেন সে ঘুম থেকে জাগছে, বা গভীর ঘুমেও তার চারপাশে কী ঘটছে তা বুঝতে পারছে। যদিও সে ঘুমন্ত ছিল, মনে হলো যেন সে আয়ানের কথা শুনতে পেয়েছে, তার প্রার্থনা বুঝতে পেরেছে, তার বিশুদ্ধ হৃদয়কে অনুভব করতে পেরেছে। ড্রাগনের বিশাল শরীর থেকে এক স্নিগ্ধ, সবুজ আভা ছড়িয়ে পড়ল। আভাটি ধীরে ধীরে গুহার বাইরে বেরিয়ে গেল, পর্বত চূড়া ভেদ করে আকাশের দিকে উঠল, যেন আকাশের দিকে এক বিশাল শক্তির স্তম্ভ উঠছে, যা পৃথিবীর সাথে আকাশকে যুক্ত করেছে, আর তার ঠিক পরেই বাইরে বজ্রপাতের শব্দ শোনা গেল। প্রথমে একটি হালকা গুড়গুড় শব্দ, তারপর একটি জোরালো শব্দ, যেন আকাশ ফেটে গেল, আর পৃথিবীর বুক কেঁপে উঠল। সেই বজ্রপাতের শব্দ গুহার ভেতরে এমনভাবে প্রতিধ্বনিত হলো যেন ড্রাগন নিজেই গর্জন করে উঠছে, আর গুহার ছাদ থেকে ছোট ছোট পাথর খসে পড়তে শুরু করল। আয়ানের মনে হলো, এই গুহা তাকে ভিতরে আটকে রাখতে চাইছে। গুহার প্রবেশপথ থেকে এক ঠান্ডা, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ এল, মনে হলো যেন কোনো অদৃশ্য প্রহরী তাকে গুহার গভীরে আটকাচ্ছে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion