সপ্তমীর সকালটা শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত আবেশে। অরুণ ঘুম থেকে উঠেছিল শাঁখ এবং উলুধ্বনির শব্দে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে দেখেছিল পাড়ার সবাই নতুন জামা পরে গঙ্গার ঘাটের দিকে যাচ্ছে। উপলক্ষ্য—নবপত্রিকা স্নান। তার কাছে এই সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান অর্থহীন এবং পুরোনো দিনের কুসংস্কার বলে মনে হয়েছিল। সে নির্লিপ্তভাবে দেখেছিল, ঢাক-ঢোলের শব্দে মুখরিত হয়ে কলা বউকে স্নান করিয়ে মণ্ডপে প্রতিষ্ঠা করা হলো।
সারাদিন ধরে মণ্ডপে ছিল প্রচণ্ড ভিড়। অরুণ ছিল এক বিচ্ছিন্ন দর্শক। তার মন বারবার লন্ডনের ফ্ল্যাটের শান্ত, গোছানো পরিবেশটা খুঁজে ফিরছিল। সন্ধ্যার দিকে মা তাকে প্রায় জোর করে মণ্ডপে নিয়ে এলেন। আরতি শুরু হতে তখনও কিছুক্ষণ বাকি। ধূপ-ধুনোর গন্ধ, মানুষের কোলাহল আর ঢাকের মহড়ার শব্দে তার মাথা ধরে যাচ্ছিল। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে শান্তি খুঁজতে সে মণ্ডপের একপাশে, যেখানে ভিড় কিছুটা কম, সেখানে সরে গেল।
সেখানেই একটা জিনিসটা তার চোখে পড়ল। ঠাকুরদালানের শ্বেতপাথরের মেঝের ওপর আঁকা এক বিশাল, অপূর্ব সুন্দর আলপনা। চালের গুঁড়ো দিয়ে আঁকা শঙ্খ, লতা, পদ্ম আর মাছের এক নিখুঁত জ্যামিতিক নকশা। শিল্পীর হাতের মুনশিয়ানা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। এই নিঁখুত, সনাতন শিল্পের দিকে তাকিয়ে অরুণের মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এলো। কিন্তু পরক্ষণেই তার চোখ পড়ল আলপনার ঠিক পাশেই রাখা এক আধুনিক স্ট্যান্ডের ওপর। সেখানে একটা বড় LED স্ক্রিনে ডিজিটাল অক্ষরে সংস্কৃত মন্ত্র ভেসে উঠছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। সনাতন শিল্পের পাশে এই যান্ত্রিক চাকচিক্য তার চোখে বড্ড বেমানান লাগল।
লন্ডনের পরিশীলিত রুচিতে অভ্যস্ত অরুণ নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে বলে উঠল, “ক্লাসিক আর্টের পাশে এ কেমন ডিজিটাল জগাখিচুড়ি! সবকিছুরই এসথেটিক্স বলে তো একটা ব্যাপার আছে।”
“ঐতিহ্যকে সময়ের সাথে না মেলালে সেটা তো মিউজিয়ামে পড়ে থাকা ফসিল হয়ে যাবে, তাই না?”
একটা মিষ্টি অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে অরুণ চমকে পাশে তাকাল। দেখল, হালকা সবুজ রঙের এক শান্তিপুরী তাঁতের শাড়ি পরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা মাটির প্রদীপ, বোধহয় আরতির জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। মেয়েটির চোখে কোনো ভর্ৎসনা নেই, আছে একরাশ কৌতূহল। সে আর কেউ নয়, রিয়া।
অরুণ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আমি ঠিক তা বলিনি। মানে, এই আলপনাটা এত সুন্দর, এত ক্লাসিক… তার পাশে এই LED স্ক্রিনটা কেমন যেন…”
রিয়া হাসল। তার গালের টোলটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। “আলপনাটা আমিই এঁকেছি।”
এবার অরুণ আরও বেশি অপ্রস্তুত হলো। সে কল্পনাও করতে পারেনি, এই নিখুঁত শিল্পকর্ম এই সাধারণ দেখতে মেয়েটির হাতে তৈরি। সে তাড়াতাড়ি বলল, “অসাধারণ! আপনার হাতে জাদু আছে। আমি সেটারই প্রশংসা করছিলাম। কিন্তু…”
“কিন্তু এই ডিজিটাল মন্ত্র আপনার ভালো লাগেনি,” রিয়া তার কথাটা শেষ করে দিল। “আসলে, আমাদের পাড়ার নতুন প্রজন্মের অনেকেই তো আর সংস্কৃত মন্ত্র পড়তে পারে না। তাদের জন্যেই এই ব্যবস্থা, যাতে তারা অন্তত দেখে তার অর্থটা বোঝার চেষ্টা করতে পারে। ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে তাকে তো নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছানোর মতো করে সাজিয়ে তুলতে হবে, তাই না?”
অরুণ মেয়েটির যুক্তির গভীরতায় মুগ্ধ হলো। সে এতদিন ঐতিহ্যকে একটা কাঁচের বাক্সে বন্দী বিশুদ্ধ বস্তু বলে ভেবে এসেছে। কিন্তু রিয়া তাকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ দেখাল। সে বলল, “আপনার পয়েন্টটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তাতে কি শিল্পের বিশুদ্ধতা নষ্ট হয় না?”
রিয়া প্রদীপটা সাবধানে নামিয়ে রেখে বলল, “কোনটা বেশি জরুরি, অরুণদা? শিল্পের বিশুদ্ধতা ধরে রেখে তাকে কিছু দর্শকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া, নাকি তার রূপটা একটু বদলে তাকে হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া? গঙ্গা তো সেই একই আছে, কিন্তু তার ওপর হাওড়া ব্রিজও তৈরি হয়েছে, আবার দ্বিতীয় হুগলি সেতুও তৈরি হয়েছে। তাতে কি গঙ্গার মহিমা কমে গেছে?”
অরুণ এই প্রথমবার বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এই মেয়েটি শুধু সুন্দরী নয়, সে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং তার চিন্তাভাবনা খুব স্পষ্ট। তাদের এই ছোট্ট তর্কাতর্কির মধ্যেই আরতি শুরু হওয়ার জন্য শাঁখ বেজে উঠল। ঢাকের বাদ্যি তীব্র হয়ে উঠল।
রিয়া হেসে বলল, “চলুন, আরতি শুরু হয়ে যাবে। তর্কের বাকি অংশটা পরেও হতে পারে।” সে নিজের নাম বলল, “আমি রিয়া।”
অরুণও সম্মোহিতের মতো বলল, “আমি অরুণ।”
আরতির সময়, যখন শত শত প্রদীপের আলোয় চারপাশ আলোকিত, তখন অরুণ দূর থেকে রিয়াকে দেখছিল। সে দেখছিল, কীভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তর্ক করা সেই যুক্তিবাদী মেয়েটিই এখন চোখ বন্ধ করে আরতির আগুনে হাত সেঁকে নিচ্ছে, তার মুখে তখন অগাধ বিশ্বাস আর ভক্তি। অরুণের মনে হলো, এই মেয়েটি যেন গঙ্গার মতোই। একই সাথে শান্ত, গভীর, আবার প্রয়োজনে নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম।
সপ্তমীর সেই সন্ধ্যায়, আলপনা আর LED স্ক্রিনের তর্কের মধ্যে দিয়ে অরুণ আর রিয়ার প্রথম আলাপ হলো। কোনো সৌজন্যের হাসি বা নিয়মমাফিক পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে নয়, বরং দুটি ভিন্ন চিন্তার জগতের সংঘর্ষ এবং মেলবন্ধনের মধ্যে দিয়ে। এই আলাপচারিতা অষ্টমীর সকালের সেই মুগ্ধতার জন্য এক সুন্দর প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিল। অরুণ তখন শুধু এক সুন্দরী, অচেনা মেয়েকে দেখবে না, দেখবে সেই বুদ্ধিমতী মেয়েটিকে, যে তাকে ঐতিহ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।
(চলবে)
Comments
Discussion
No commentsPlease sign in to join the discussion