Episode 3939 words1 views

তৃতীয় অধ্যায় : ঐশ্বরিক অনুভূতির দিন

অষ্টমীর সকালটা শুরু হলো এক অন্য সুরে, যা লন্ডনের যান্ত্রিক অ্যালার্ম ক্লকের থেকে লক্ষ যোজন দূরে। অরুণ ঘুম থেকে উঠেছিল ঢাকের গুরুগম্ভীর আওয়াজে। সেই আওয়াজে কোনো কর্কশতা ছিল না, ছিল এক উদাত্ত আহ্বান। সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ভোরের বাতাসে ছিল শিউলি ফুলের তীব্র, মিষ্টি গন্ধ আর হালকা শিশিরের ভেজা আমেজ। পাড়ার রাস্তা দিয়ে নতুন জামা পরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাসতে হাসতে ছুটে যাচ্ছে। তাদের দেখে অরুণের নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ল, যা এখন এক বিবর্ণ ছবির মতো। তার মা, মিনতি দেবী, ঘরে ঢুকলেন এক ভাঁজ করা গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে। “ওঠ বাবা, স্নান করে নে। আজ অন্তত আমাদের সাথে অঞ্জলিটা দিতে চল।” অরুণের যেতে ইচ্ছে করছিল না। এই ভিড়, এই কোলাহল তার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছিল। সে বলতে যাচ্ছিল, “মা, আমার ভালো লাগছে না।” কিন্তু তার মা যেন তার মনের কথা বুঝতে পারলেন। তিনি অরুণের পাশে বসে তার মাথায় হাত রাখলেন। “জানি, তোর এসব আর ভালো লাগে না। কিন্তু আমরা তো আর বেশিদিন নেই। আজ আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে চল। দেখবি, ভালো লাগবে।” মায়ের গলার স্বরে এমন এক আকুতি ছিল, যা অরুণ উপেক্ষা করতে পারল না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নান করতে গেল। গরদের ধুতিটা পরতে গিয়ে তার রীতিমতো যুদ্ধ করতে হলো। দশ বছরে সে ভুলে গেছে কীভাবে পরতে হয়। শেষে মায়ের সাহায্যে যখন সে তৈরি হলো, তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে তার অদ্ভুত লাগছিল। এই পোশাকে তাকে ঠিক তার বাবার মতো দেখাচ্ছে। যে বাবার থেকে সে সারাজীবন দূরে পালাতে চেয়েছে, আজ যেন তারই প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে সে। বাড়ি থেকে চ্যাটার্জী বাড়ির ঠাকুরদালান পর্যন্ত পথটা ছিল মাত্র দু মিনিটের। কিন্তু এইটুকু পথেই অরুণ অনুভব করল, সে যেন এক অচেনা গ্রহের প্রাণী। পাড়ার যে কাকিমা বা মাসিমারা তাকে দেখে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন, তাদের কাউকেই সে চিনতে পারছিল না। সবাই তার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল, যেন সে কোনো মিউজিয়ামের দ্রষ্টব্য বস্তু। সে অনুভব করছিল এক তীব্র বিচ্ছিন্নতা। সকালের অঞ্জলি: মণ্ডপে পৌঁছেই সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ধূপ-ধুনোর গন্ধ, ঢাকের গুরুগম্ভীর আওয়াজ আর পুরোহিতের গম্ভীর মন্ত্র—সবকিছু মিলে এক স্বর্গীয় পরিবেশ। আর সেই পরিবেশের কেন্দ্রে সে রিয়াকে দেখল। ছবির ক্যানভাসটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল অরুণের চোখের সামনে। পুরোনো জমিদারবাড়ির ঠাকুরদালান। পেছনে দেবী দুর্গার প্রতিমা, যার মুখে স্নিগ্ধ হাসি। বড় বড় থাম, ঝাড়বাতির হলদে আলো এবং ধূপ-ধুনোর ধোঁয়ায় চারপাশটা কিছুটা মায়াবী এবং ঝাপসা। আর সেই ক্যানভাসের কেন্দ্রে ছিল রিয়া। সাদা গরদের শাড়ি, চওড়া টুকটুকে লাল পাড়। পিঠের ওপর একরাশ কালো চুল খোঁপা করে বাঁধা, তাতে গোঁজা একগুচ্ছ সদ্য ফোটা শিউলি ফুল। কপালে চন্দনের ফোঁটার ওপরে একটা ছোট্ট লাল টিপ। সে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে এক অপার্থিব ভক্তি এবং শান্তি। ছবির একপাশে, একটি থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল অরুণ। তার দৃষ্টি সরাসরি রিয়ার ওপর নিবদ্ধ। তার চোখে ছিল বিস্ময়, মুগ্ধতা এবং এক গভীর অনুসন্ধিৎসা। অরুণের মনে হলো, সে যেন কোনো শিল্পীর ক্যানভাস থেকে উঠে আসা এক জীবন্ত ছবি। তার মধ্যে কোনো আধুনিকতার চাকচিক্য ছিল না, ছিল এক সনাতন সৌন্দর্য, যা হাজার বছর ধরে কবিদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। পুরোহিতের গম্ভীর মন্ত্র উচ্চারণের সাথে সাথে সে যখন চোখ বন্ধ করল, তার ঠোঁট দুটো আলতো কাঁপছিল। তার মুখটা এক অপার্থিব আলোয় ভরে উঠল। অরুণের মনে হলো, এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই হয়তো ঈশ্বর তাকে এই দশ বছর পর ফিরিয়ে এনেছেন। তার কর্পোরেট জগৎ, তার সাফল্য, তার ভবিষ্যৎ—সবকিছুই এই মুহূর্তটার কাছে অর্থহীন হয়ে গেল। অঞ্জলি দেওয়ার সময়, যখন হাজারো কণ্ঠ একসাথে মন্ত্র উচ্চারণ করছিল, তখন অরুণের মনে হলো, সে এই সম্মিলিত প্রার্থনার অংশ হয়ে যাচ্ছে। রিয়া যখন চোখ খুলল, তখন তাদের দৃষ্টি বিনিময় হলো। সেই কয়েক মুহূর্তের জন্য অরুণ ভুলে গিয়েছিল তার লন্ডন, তার কেরিয়ার, তার একাকীত্ব। সে শুধু দেখেছিল দুটি গভীর, কালো চোখ, যা তাকে কোনো এক অজানা জগতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। দুপুরের ভোগ ও বিকেলের ভ্রমণ: একসাথে বসে ভোগ খাওয়ার সময় সৌরভের সাথে তার সেই সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ কথোপকথন হলো। অরুণ অবাক হয়ে দেখল, কীভাবে রিয়া খুব শান্তভাবে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে তার পক্ষ নিয়েছিল। বিকেলে রিয়ার সাথে উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো দেখতে যাওয়াটা ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। শোভাবাজার রাজবাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণ, লাহা বাড়ির সাবেকি প্রতিমা—রিয়া যেন এক উত্তেজিত গাইড। সে অরুণকে শুধু প্রতিমা দেখাচ্ছিল না, দেখাচ্ছিল কলকাতার আত্মাকে। এই ভ্রমণের সময় তাদের মধ্যে অনেক কথা হলো। অরুণ প্রথমবার অনুভব করল, সে কারো সাথে কথা বলতে গিয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে। গঙ্গার ঘাটে সূর্যাস্ত: সেই সন্ধ্যায় তারা দুজনে গঙ্গার ধারে চ্যাটার্জী বাড়ির পুরোনো শ্যাওলা ধরা বাঁধানো ঘাটটায় গিয়ে বসল। শান্ত গঙ্গা, জলে সূর্যাস্তের লাল-কমলা আভা। দূরে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আবছা সিলুয়েট। অরুণ এবং রিয়া ঘাটের সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে আছে। সূর্যাস্তের আলোয় রিয়ার মুখের একপাশে একটা নরম আভা তৈরি হয়েছিল, তার কানের দুলের রুপো চিকচিক করছিল। হাওয়ায় তার খোলা চুলের কয়েকটা strand উড়ে এসে বারবার তার গালে পড়ছিল। অরুণ নিজের অজান্তেই চেয়ে রইল সেই দিকে। অরুণ তার লন্ডনের জীবনের কথা, তার একাকীত্বের কথা রিয়াকে খুলে বলল। সে বলল, “জানেন রিয়া, আমি বিলিয়ন পাউন্ডের ডিল সামলাই, কিন্তু দিন শেষে আমার এমন কেউ নেই যাকে ফোন করে বলতে পারি, ‘আজ মনটা ভালো নেই’।” কথাগুলো বলার সময় তার গলাটা ধরে আসছিল। রিয়া চুপ করে সব শুনল। তারপর সে অরুণের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, “নির্বাসন তো শুধু ভৌগোলিক হয় না, অরুণদা। মনের নির্বাসনটাই সবচেয়ে যন্ত্রণার। আপনি শহর ছেড়েছেন, কিন্তু নিজের শিকড়টাকে ছাড়তে পারেননি। তাই তো এই যন্ত্রণা।” রিয়ার কথায় অরুণ সম্মোহিতের মতো হয়ে রইল। রিয়ার যে চুলগুলো হাওয়ায় উড়ে এসে তাকে বিরক্ত করছিল, অরুণ খুব আলতো করে, প্রায় সাহসের শেষ বিন্দু দিয়ে, হাত বাড়িয়ে সেই চুলগুলো তার কানের পেছনে গুঁজে দিল। অরুণের আঙুলের সামান্য স্পর্শে রিয়ার সারা শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে চমকে অরুণের দিকে তাকাল। অরুণও অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি হাতটা সরিয়ে নিল। যে হাতটা দিয়ে সে কোটি কোটি পাউন্ডের চুক্তি সই করে, সেই হাতটা আজ সামান্য একটা স্পর্শে কেঁপে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একটা দীর্ঘ, গভীর নীরবতা নেমে এলো। সেই নীরবতায় কোনো অস্বস্তি ছিল না, ছিল এক নতুন অনুভূতির জন্মলগ্ন। সূর্যাস্তের শেষ আলোয় গঙ্গার জল চিকচিক করছিল, আর দুটি মানুষ খুঁজে পাচ্ছিল তাদের নিজেদের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। অষ্টমী শেষ হলো এই নীরব প্রতিশ্রুতিতে, যা কোনো শব্দের চেয়েও বেশি কথা বলেছিল। (চলবে)

Share this story

Comments

Discussion

No comments

Please sign in to join the discussion